• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

উপকূলীয় চরাঞ্চলের কালো সোনা এবং অবিবেচিত কিছু সমস্যা

মজনু সরকার

প্রকাশিত: ১৫:২৯, ১২ এপ্রিল ২০২২

আপডেট: ১৬:৪০, ১২ এপ্রিল ২০২২

ফন্ট সাইজ
উপকূলীয় চরাঞ্চলের কালো সোনা এবং অবিবেচিত কিছু সমস্যা

‘ওকি মইষাল বন্ধু রে, ছাড়িয়া যান না মোক, কাগাশিয়ার ঘরে রে’, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে’-এক সময়ের জনপ্রিয় এই গানগুলো যেমন এখন আর শোনা যায় না, তেমনি গানে বর্ণিত গ্রাম-বাংলার মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে যাওয়া মহিষ, মইষাল বন্ধু এবং মহিষের গাড়ি হাকিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেশব্যাপি এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। 

দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ এবং কৃষির বাণিজ্যিকিরণের কারণে চারণভূমি কমে যাওয়ায় দেশব্যাপি এখন আর নেই সেই মহিষ, নেই সেই মইষাল বন্ধু, নেই সেই হৈ হৈ রৈ রৈ হাকের ডাক এবং মহিষের গলায় ঝোলানো ঘণ্টার টুং টাং শব্দ। মহিষ আজ আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারাতে বসেছে। এক সময় দেশব্যাপি মহিষের পূর্বপুরুষদের বিচরণ থাকলেও চারণভূমির অভাবে একদিকে দেশব্যাপি মহিষ বিচরণ কমতে থাকে, অন্যদিকে উপকূলীয় চরাঞ্চলসহ পদ্মা, যমুনা, বক্ষ্রপুত্র নদীর অববাহিকা ও দেশের বিভিন্ন হাওরাঞ্চলে চারণভূমির আধিক্যসহ অন্যান্য তুলনামূলক সুবিধা থাকায় এসব অঞ্চলে মহিষ পালন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবেই কয়েক পুরুষ ধরে মহিষ এসব অঞ্চলে থিতু হয়ে যায়। কয়েক পুরুষ ধরে মহিষ এসব অঞ্চলে থিতু হলেও নানাবিধ সমস্যার কারণে তাদের উৎপাদনশীলতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে তারা দেশে বিদ্যমান দুধের ঘাটতি ও মাংস উৎপাদনে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারেনি অথচ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে মোট দুধ ও মাংস উৎপাদনের যথাক্রমে ৫০ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ আসে মহিষ থেকে। বর্তমানে দেশজ দুধ (মোট দুধ উৎপাদন ১০৬.৮ লাখ মেট্রিক টন) ও মাংস উৎপাদনে (মোট মাংস উৎপাদন ৭৬.৭৪ লাখ মেট্রিক টন) মহিষের অবদান মাত্র ০.৩৩ শতাংশ (৩৫,৯৮৩ মেট্রিক টন) এবং ০.০৯ শতাংশ (মোট মহিষের মাংস উৎপাদন ৬৯৬৬ মেট্রিক টন), যা আসে দেশে বিদ্যমান প্রায় ১৫ লক্ষ মহিষ থেকে (তথ্যের উৎস: এফএফও-২০১৯)।

মোট মহিষের শতকরা ৪০ শতাংশই উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। উপকূলীয় জেলার চরাঞ্চলগুলোতে মহিষ পালনের তুলনামূলক সুবিধা প্রায় একই ধরণের হওয়ার কারণে মহিষ পালন পদ্ধতি, সম্ভাবনা এবং উন্নয়নের অন্তরায়সমূহ প্রায় একই। পিকেএসএফ এর অর্থায়নে বিভিন্ন সহযোগী সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে মহিষ উপ-খাত উন্নয়নে প্রায় ৪ বছর ধরে বাস্তবায়িত প্রকল্পের সাথে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা, মাঠ পর্যবেক্ষণ, মতবিনিময়, নিজস্ব জরিপ, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত, বিভিন্ন প্রাইমারী ও সেকেন্ডারি উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেরদের অনুসন্ধানী চোখে ২০১৫-২০২২ সাল পর্যন্ত ধরাপড়া উপকূলীয় চরাঞ্চলে মহিষ উপ-খাতের উন্নয়নের অপ্রকাশিত সমস্যাসমূহ নিম্নরুপ-

১। আন্ত:প্রজনন সমস্যা: উপকূলীয় চরাঞ্চলে মহিষের উৎপাদনশীলতা হ্রাসের অন্যতম প্রদান কারণ ইনব্রিডিং (আন্ত:প্রজনন) সমস্যা। চরের প্রায় ১০০ শতাংশ খামারী প্রায় ১০০ শতাংশ বাথানে তাদের নিজেদের বাথানে উৎপাদিত ষাড় মহিষ দিয়ে মাদী মহিষকে বংশানুক্রমে পাল দিয়ে আসছে। ফলে মহিষের উৎপাদনশীলতা (দুধ ও মাংস) ক্রমান্নয়ে হ্রাস পেতে পেতে বর্তমানে মহিষ প্রতি দৈনিক দুধের উৎপাদন ১.২৫-১.৫০ লিটারে (উৎপাদনকাল গড়ে ১৬৫-১৮০দিনে) এবং গড় ওজন ২৫০-২৬০ কেজিতে পৌঁছেছে অথচ খামারীদের নিকট থেকেই শোনা এই মহিষগুলোর দাদা বা তার দাদা মহিষগুলোর (২০-২৫বছর পূর্বে) গড়ে দৈনিক দুধ উৎপাদন ছিল ৫-৬ লিটার এবং ওজন ছিল ৩০০-৩৫০ কেজি। 

২। উচ্চ মৃত্যু ও রোগাক্রান্তের হার: উপকূলীয় চরাঞ্চলের বাথানগুলোতে প্রায় ১০০ শতাংশ খামারি মহিষকে কোন রকম ভ‍্যাকসিন দিত না এবং কৃমিনাশক খাওয়াতো না, ফলে এসব অঞ্চলের চরগুলোতে ৬ মাস বয়সের উপরের মহিষের মৃত্যুর হার ছিল গড়ে ১০-১২ শতাংশ এবং ৬ মাস বয়সের নিচের মহিষের (বাচ্চা মহিষ) মৃত্যুর হার ছিল গড়ে ১৫-১৮ শতাংশ এবং নানান রোগে আক্রান্তের হার প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ। ৬ মাস বয়সের নিচের মহিষ প্রধানত মা অপুষ্টিতে ভূগে মারা যায় (৮০-৯০ শতাংশ বাচ্চা অপুষ্টিতে ভুগে মারা যায়)। এছাড়া বন‍্যার পানিতে ভেসে  (২-৩ শতাংশ), প্রচন্ড শীতের নিউমোনিয়াতে (১০ শতাংশ), এসকারিয়াসিস রোগে (৫-৭ শতাংশ), লবনাক্ততা পানি খেয়ে (১-২ শতাংশ) এবং ডায়ারিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় (২-৩ শতাংশ) বাচ্চা মারা যায়। আর বড় মহিষ মারা যাওয়ার অন্যতম প্রধানত কারণ গলাফুলা রোগ। এ রোগে সাধারণত প্রায় ৬০ শতাংশ মহিষ মারা যায়। এছাড়া ক্ষুরারোগে (৫-১০ শতাংশ), নাইট্রেট পয়জনিং-এ (১০ শতাংশ) এবং বজ্রপাতে প্রতিবছর প্রায় চরে ১-২ শতাংশ বড় মহিষ মারা যায়। চরগুলোতে বাচ্চা মহিষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে নিউমোনিয়াতে (৭০ শতাংশ), এরপর ডায়ারিয়াতে (১০-২০ শতাংশ) এবং নাইট্রেট পয়জনিং –এ ৫ শতাংশ। বড় মহিষ সাধারণত গলাফুলা রোগে (৬০-৭০ শতাংশ), ক্ষুরারোগে (১০-১৫ শতাংশ) এবং নাইট্রেট পয়জনিং (১০-১৫ শতাংশ) আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়া প্রায় সব বয়সের মহিষ বছরের কোন না কোন সময় অন্ত: পরজীবি এবং বহিপরজীবি দ্ধারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।

৩। চরের ভূমি ব্যবহারের জটিলতা ও অসম-বণ্টন: উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে ভোলাতে ৯০ শতাংশ মহিষ চরের বাথানে পালিত হয়। ভোলায় দুই ধরণের চর রয়েছে। স্থায়ী চর এবং নতুন জেগে উঠা চর। এই সব চরই হলো বাথানে মহিষ পালনের একমাত্র চারণভুমি, যেখান থেকে ১০০ শতাংশ মহিষের শতভাগ খাদ্যের যোগান আসে। স্থায়ী চরের মালিকানা সাধারণত বন বিভাগের হাতে থাকে (৫-১০ শতাংশ), স্থানীয় লোক জনগণের হাতে (২০-৩০ ভাগ), স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে (৫০-৬০ ভাগ), স্থানীয় ভূমি অফিসের হাতে (১৫-২০ ভাগ) থাকে। অফিসিয়ালি ভূমি অফিসের হাতে ১৫-২০ শতাংশ জমির মালিকানা থাকলেও এসব অধিকাংশ জমিই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভোগ-দখল করে রাখেন। 

বনবিভাগের জমি সাধারণত কিছু অসাধু কর্মকতাদের যোগসাজসে স্থানীয়রা তাদের কিছু প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যে জমিতে মহিষ গেলে ঐ দালালদের উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে মহিষ ছাড়াতে হয় অথবা তাদের হাতে নির্যাতিত হতে হয়। মালিকানা অনুযায়ী এই সব চরগুলো স্থানীয় সাধারণ মানুষদের ভোগ-দখলে থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে চরগুলো দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা প্রথা ও শক্তির জোর অনুযায়ী স্থায়ী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ভোগ-দখল করে আসছে। ভোলায় মোট ৩২ টি অস্থায়ী (নতুন চর) এবং ৭৪টি স্থায়ী চর রয়েছে, এর মধ্যে ৪৫টি চর মহিষ চরানোর জন্য উপযোগী। এই সব চর প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ স্থানীয় মহিষের মালিকদের কাছে নির্দিষ্ট রেটে নির্দিষ্ট  পরিমাণ জমি (চর) বছরভিত্তিক ইজারা দিয়ে থাকে। সাধারণত বছরে প্রতি একর চরের জমি বাবদ ৩০০০-৪০০০ টাকা করে ইজারা দিতে হয় মহিষের মালিকদের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে থাকা জমির জন্য।  খাস জমি অথাৎ ভূমি অফিসের দখলে থাকা জমির জন্য একর প্রতি ২০০০-৩০০০ টাকা করে ভূমি অফিসের প্রতিনিধিদের দিতে হয়, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কার্ডের মাধ্যমে দেয়া জমির জন্য জমির মালিককে একর প্রতি বাৎসরিক ৪০০০-৫০০০ টাকা করে দিতে হয়। যেসকল মহিষের মালিকদের সাথে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সর্ম্পক ভালো এবং টাকার জোর বেশি তারাই তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমান চরের জমি মহিষের চারণভূমি হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ পায়। চারণভুমি হিসাবে এই যে চরের ভূমি ব্যবহারের জটিলতা ও অসম-বন্টন  উপকূলীয় অঞ্চলে মহিষ পালনের একটি অন্যতম প্রধান অন্তরায়, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সাধারণত ২০-২৫টি মহিষের খাদ্যের জন্য চরে সাধারণত ৩০-৩৫ একর জমির প্রয়োজন হয়ে থাকে।

৪। চরে খাদ্য সংকট: চরে সাধারণ বছরে ৭ মাস (মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পযর্ন্ত ) প্রচুর ঘাস থাকে এবং অবশিষ্ট ৫মাস (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পযর্ন্ত) ঘাস থাকে না। এই অবশিষ্ট ৫ মাস চরে মহিষদের জন্য প্রচণ্ড খাদ‍্য সংকট দেখা দেয়। ফলে খাদ্যের অভাবে মহিষের দুধ উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এ সময় অনেক মহিষের বাচ্চা (১ দিন বয়সী থেকে ৩ মাস বয়সী পযর্ন্ত ) খাদ্য ও দুধের অভাবে পুষ্টিহীনতায় মারা যায় (এ সময় বাচ্চা মহিষের মৃত্যুর হার প্রায় ৩-৪ শতাংশ), বাচ্চার গ্রোথ কমে যায় যা তাদের দেরীতে সেক্সচুয়াল ম্যাচিউরিটিতে আসতে বাধ‍্য করে। একদিকে এই অফ সময়ে চরে ঘাস থাকে না অন্যদিকে এসময়ে অনেক চরের জমি তরমুজ চাষের জন্য ইজারা দেয়া হয় ফলে তরমুজ চাষের আওতায় আসা জমি ৩ মাসের জন্য ব্লক হয়ে যায় (ডিসেম্বর-মাচ পর্যন্ত), অন্যদিকে ধানের জন্য জমিটি ব্যবহার করলে সেটিও ৩ মাসের জন্য ব্লক হয়ে যায় (অক্টোবর-ডিসেম্বর পযন্ত)। এভাবে তরমুজ ও ধান চাষের জন্য চরের একটি অংশ (প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ), ৬ মাস ব্লক থাকে। 
এসময় মহিষ খামারীরা এ অঞ্চলে মহিষ চরাতে পারে না।  ফলে এ সময় চরে মহিষদের চরানোর জন্য পর্যাপ্ত চর থাকে না যা খাদ্য সংকটের অন্যতম কারণ। দিন দিন তরমুজ চাষের আওতায় চরের ঘাসের জমি বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। বর্তমানে ভোলার সবগুলো উপজেলার প্রায় ১২টি চরে প্রায় ২২ হাজার একর বিছিন্ন জমি রয়েছে, যেখানে ২০১৫ সালে ৩ হাজার একর জমিতে তরমুজ চাষ হতো, সেখানে ২০২০ সালে তরমুজ চাষ হয়েছে ১২ হাজার একর জমিতে, ক্রমাগত তরমুজ চাষ সম্প্রসারণ এ অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মহিষ পালনকে মারাত্বক হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে।

৫। খাদ্য প্রদান অনুশীলনে সমস্যা: চরের শতভাগ বাথানে প্রায় সব মহিষই প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে। সচেতনতার অভাবে মহিষকে কোন প্রকার দানাদার খাদ্য প্রদান করা হয় না। অথচ গবেষণায় দেখা গেছে কোন মহিষ থেকে শতভাগ উৎপাদন (দুধ ও মাংস) ও পুনুরুৎপাদন পেতে হলে তাকে তার দৈহিক ১০০ কেজি ওজনের জন্য ন্যূনতম ১২-১৫ কেজি আশজাতীয় খাদ্য (কাঁচা ঘাস)  এবং ০.৭৫-১ কেজি দানাদার খাদ্য প্রদান করতে হবে। চরের বাথানে পালিত মহিষের উৎপাদনশীলতা ও পুনুরুৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মহিষকে তার দৈহিক ওজন ও উৎপাদনশীলতা অনুযায়ী কাঁচা ঘাসের সাথে কোন প্রকার দানাদার খাদ্য প্রদান করা হয় না।

৬। দুধ দহনে অক্সিটোসিন হরমোনের ব্যবহার: ওলান থেকে দ্রুত এবং শতভাগ দুধ নামানোর জন্য ৮০-৯০ ভাগ বাথানে সারাবছর অক্সিটোসিন হরমোন ব্যবহার করা হয় তবে ল্যাকটেশন শুরুর ১-১.৫ মাস পর থেকেই বিশেষ করে নভেম্বব থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পযন্ত এটি বেশি ব্যবহার করা হয়। যার ফলে দুধ উৎপাদনকাল কমে যায়, হিটে আসার সময় দীর্ঘায়িত হয়। সাধারণত ১০-২০ ভাগ বাথানে অক্সিটোসিন হরমোন ব্যবহার না করে মোট দুধের গড়ে ৭৫ শতাংশ মহিষ থেকে দোহন করা হয় এবং ২৫ ভাগ ‍দুধ বাছুরের খাওয়ার জন্য রাখা হয়, অবশিষ্ট ৮০-৯০ ভাগ বাথানে অক্সিটোসিন হরমোন ব্যবহার করে মহিষ থেকে শতভাগ দুধ সংগ্রহ করে তা বিক্রি করা হয়ে থাকে, ফলে অক্সিটোসিন ব্যবহৃত বাথানে বাছুরের খাওয়ানোর জন্য কোন প্রকার দুধ রাখা হয় না। এটি ওই সকল বাথানে বাছুরের অপুষ্টির একটি অন্যতম কারণ। উপরোন্ত এ সময় মাঠে পর্যাপ্ত ঘাসও থাকে না। এছাড়া অক্সিটোসিন ব্যবহারের অন্যতম কারণ-মালিকরা সাধারণত গোয়ালাদের কাছ থেকে বছরভিত্তিক বাথানের দুধ বিক্রির জন্য চুক্তির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমানে দাদন নিয়ে থাকে। এমনিতেই এ সময় দুধ সাধারণ সময়ের চেয়ে ৩০-৪০ ভাগ কম হয়, এর সাথে গোয়ালাদের কাছে নির্দিষ্ট পরিমানে দুধ বিক্রির চুক্তির একটি মানসিক চাপ থাকে। খামারীরা এসব অক্সিটোসিন (স্থানীয় ভাষায় যাকে অক্সিজেন দেয়া বলে) হরমোন সাধারণত গোয়ালাদের প্ররোচনায় ব্যবহার করে থাকে। 

৬। বাসস্থান বা আশ্রয়স্থলের সমস্যা: মহিষের খাদ্যের একমাত্র উৎস হিসাবে ব্যবহৃত চরাঞ্চলের একটি বড় অংশ জোয়ার–ভাটার কারণে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পানিতে ডুবে থাকে (দৈনিক প্রায় ২.৫-৩ ঘণ্টা)। প্রতিবছর বন্যার সময় বিশেষ করে মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায়ই হঠৎ করে উচ্চ বন্যা হয়ে থাকে। এছাড়া প্রায় বছরই উপকূলীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে। হঠাৎ উচ্চ বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় প্রতিবছর চরে সকল মহিষের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসস্থল বা আশ্রয়স্থল (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় কিল্লা, চরে মাটি উচু করে মহিষের থাকার জায়গা) না থাকার কারণে প্রায় বাথানে কমবেশি অনেক মহিষ বিশেষ করে বাচ্চা মহিষ পানিতে ভেসে ও ডুবে মারা যায় (প্রায় ১-২ ভাগ)। এছাড়া প্রচণ্ড শীতের সময় খোলা আকাশের নীচে ভেজা মাটিতে দীর্ঘ সময় অবস্থানের কারনে নিউমোনিয়ায় প্রতিবছর অসংখ্য বাচ্চা মহিষ মারা যায়। এছাড়া প্রায় বছরে বজ্রপাতেও অনেক মহিষ মারা যায়। শুধুমাত্র চরে মহিষদের জন্য বাসস্থান বা কিল্লা না থাকার কারণে বন্যার পানিতে ডুবে, নিউমোনিয়ায় এবং বজ্রপাতে বিগত ৫ বছরে প্রকল্পের কর্ম-এলাকায় ভোলার ৩৪টি চরে  প্রায় শতাধিক মহিষ মারা গেছে।

৭। অপুষ্টি সমস্যা: প্রায় সব চরে প্রায় সব মহিষ বছরের কোন কোন সময় অপুষ্টিতে ভুগে থাকে, যা তাদের উৎপাদনশীলতা ও পুনুরুৎপাদনশীলতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। এছাড়া চরে বাথানে ৬ মাস বয়সের নীচের বয়সী বাচ্চার মৃত্যর অন্যতম কারণ পুষ্টিহীনতা।  চরগুলোতে পুষ্টিহীনতা প্রথম কারণ বাচ্চার জন্মের পর থেকে দুধ ছাড়ানো পযন্ত প্রয়োজন অনুযায়ী দুধ না পাওয়া । দ্বিতীয় কারণ-সারা বছর চরে পর্যাপ্ত পরিমানে ঘাস না থাকায় মহিষদের চাহিদা অনুযায়ী ঘাস না পাওয়া। তৃতীয় কারণ- মহিষকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কোন প্রকার দানাদার খাদ্য প্রদান করা হয় না অথচ প্রতি ১০০ কেজি ওজনের জন্য মহিষকে ন্যূনতম ০.৭৫০-১ কেজি দানাদার খাদ্য প্রদান করতে হয়। এছাড়া চরে বহিঃপরজীবি ও অন্তঃপরজীবির আক্রান্ত (চরের প্রায় সব মহিষ পরজীবি দ্ধারা আক্রান্ত ) এবং জোকের আক্রমন চরের মহিষের পুষ্টিহীনতার একটি বড় কারণ হিসাবে পাওয়া গেছে (প্রায় সব মহিষ জোকের আক্রমনের শিকার হয়ে থাকে এবং একটি  মহিষ জোক দ্ধারা আক্রান্ত হয়ে দৈনিক গড়ে ২৫-৭০মিলি পযন্ত রক্ত হারিয়ে থাকে)।

৮। চরে বিভিন্ন উপকরণ ও সেবার অপ্রাপ্যতা: মহিষের চারণভূমি হিসাবে বিবেচিত উপকূলীয় চরাঞ্চলগুলো সাধারণত মূল ভূখন্ড থেকে দূরে অবস্থিত। মুল ভূখন্ড থেকে চরে যাতায়াতের জন্য নৌপথ হচ্ছে একমাত্র পথ, যেখানে যেতে  ট্রলার অথবা স্প্রীডবোট ব্যবহার করতে হয়। সাধারণত এসব চরে মূল ভূখন্ড থেকে নিয়মিত কোন ট্রলার যায় না, একটি নিদিষ্টি সময়ে দৈনিক একবার গোয়ালাদের ট্রলার দুধ আনতে যায়। গোয়ালাদের এসব ট্রলারে করে চরে অবস্থিত মহিষের জন্য বিভিন্ন উপকরণ (বিশেষ করে ঔষধ ও ভ্যাকসিন) এবং মহিষ অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেয়ার জন্য সার্ভিস প্রোভাইডাররা গিয়ে থাকে। এসব চরে যেতে গড়ে ১-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। একটি ট্রলার নিয়ে একবার যাতায়াতে গড়ে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা এবং স্পীডবোটে গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়ে থাকে। ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ার কারণে চরে মহিষের জন্য অত্যাবশকীয় উপকরণ ও সেবার প্রাপ্যতা অনেকটা নেই বললেই চলে (প্রাপ্যতা ১০ ভাগের বেশি হবে না, কোন কোন উপকরণ ও সেবা একেবারেই নেই-০%)।

৯। কারিগরি লোকবলে অভাব: মহিষের চারণভূমি হিসাবে চরাঞ্চলগুলো মূলভূখন্ড দূরে, ব্যয়বহুল, কষ্টসাধ্য, দুর্গম এবং রিস্কি বলে কারিগরি সেবার দেয়ার জন্য প্রয়োজন হলে সহসায় মূল ভূখন্ড থেকে ডাক্তাররা (৯০% জনবল) অধিকাংশ চরে (৯০% চরে) যেতে চায় না। উপরোন্ত এসব অঞ্চলে প্রাণির সংখ্যার তুলনায় সরকারি-বেসরকারি কারিগরি সেবা প্রদানকারী জনবলে যথেষ্ট অভাব রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে-এক ভোলা জেলার ৭টি উপজেলায় বিসিএস প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও ভেটেরিনারি সার্জন মিলে ১৫টি পদ থাকলেও ২০১৬সালে ১১টি পদ শূণ্য ছিল, ২১টি ভেটেরিনারি ফিল্ড অফিসারের বিপরীতে ৯ জন জনবল ছিল এবং গরুকে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ৭ জন কৃত্রিম প্রজননকর্মী থাকলেও মহিষের জন্য কোন কৃত্রিম প্রজননকমী ছিল না। বেসরকারি পর্যায়ে যারা চিকিৎসা সেবা প্রদানের সাথে জড়িত এমন সার্ভিস প্রোভাইডারের সংখ্যাও অনেক কম প্রায় ১৫০ জনের মতো। এই সময় ভোলা জেলাতে সরকারি হিসাবে ৩ লক্ষাধিক গবাদিপ্রাণি (প্রায় ৯৫,০০০ গরু, ৯১,০০০ মহিষ, ১,৫০,০০০ ছাগল ও ভেড়া) এবং ৫৫ লক্ষাধিক হাঁস ও মুরগি ছিল। এই বিপুল সংখ্যক গবাদিপ্রাণী  ও হাঁস মুরগির জন‍্য সরকারি -বেসরকারি জনবলের সংখ্যা মাত্র ১৭০ জনের মতো। জনবল ও প্রাণির অনুপাত ১: ২০০০ (গবাদিপ্রাণির অনুপাত) এবং ১:৩২,৩৫২ (হাস-মুরগির অনুপাত)। একদিকে জনবলের সংখ‍্যা প্রয়োজনানুযায়ী অত‍্যন্ত কম, অন্যদিকে এসকল জনবল বিশেষ করে সরকারি জনবল প্রধানত মূল ভুখণ্ড কেন্দ্রীয় গবাদিপ্রাণিদের কারিগরি ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে।
 
১০। রাখালদের উপর নিভরশীলতা: উপকূলীয় চরাঞ্চলে বিশেষ করে ভোলায় ৯০% মহিষ বাথানে লালন-পালন করা হয়ে থাকে। চরের একটি বাথানে সাধারণত গড়ে ৪-৫জন মালিকের ৫০-১০০টি মহিষ থাকে (সর্বোচ্চ ১ জন মালিকের ৫০০টি পযন্ত মহিষ পাওয়া গেছে)। এই বাথানগুলোতে পালিত মহিষ সাধারণত মহিষের প্রকৃত মালিকগণ দেখভাল করে না। তারা কালেভদ্রে বাথানে এসে মহিষের খোজ খবর নিয়ে থাকে, ফলে অধিকাংশ মালিক মহিষের প্রকৃত সংখ্যা জানে না এবং মহিষ লালন-পালনের জন্য তাদের পুরোপুরি রাখালদের উপর নির্ভর করতে হয়। সাধারণত প্রতিটি বাথানে ২-৪ জন করে রাখাল/বাথ্যাইননা একত্রে থেকে মহিষ দেখভাল করে থাকে (গড়ে ২৫-৩০টি মহিষের জন্য ১ জন রাখাল থাকে)। এই রাখালদেরকে মালিকগণ বছরভিত্তিক চুক্তিতে বাথানে রাখেন। ১ জন রাখালের পিছনে মালিকের মাসিক গড়ে ১৬,০০০-২৩,০০০টাকা ব্যয় হয়। এসব রাখাল চরের কিল্লাগুলোতে অবস্থান করে মহিষ দেখভাল করে থাকে। রাখালরা প্রায় সবাই অশিক্ষিত, তাদের প্রয়োজনীয় কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানও নেই।
 
১১। মহিষের মালিকদের আচরণগত সমস্যা: উপকূলীয় অঞ্চলে চরের বাথানে পালিত মহিষের ক্ষেত্রে দেখা যায় অধিকাংশ প্রকৃত মালিকগণ (প্রায় ৮০%) এসব মহিষ পালনের সাথে সরাসরি জড়িত না। তারা রাখালের মাধ্যমে মহিষ লালন-পালন করে থাকে। ফলে অধিকাংশ মালিকগণের বাথানে মহিষ পালনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ সর্ম্পকে বাস্তবিক ধারণা নেই । এছাড়া এ অঞ্চলে বাথানে পালিত মহিষের মালিকগণ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের গরু, ছাগল, ভেড়া পালনকারীদের তুলনায় অথনৈতিকভাবে বেশি স্বাবলম্বী (২০-২৫টি মহিষের মালিকগণ বছরে শুধু লাইভ মহিষ বিক্রি করে গড়ে ৪-৫ লাখ টাকা, ৫০-৬০টি মহিষের  মালিকগণ বছরে ৮-১০ লাখ টাকা এবং ১০০-১৫০ মহিষের মালিকগণ বছরে ১৫-২০ লাখ টাকা আয় করে থাকে) বলে প্রচলিত মহিষ পালন পদ্ধতি পরিবর্তন করে উন্নত পদ্ধতিতে পালনসহ এবিষয়ক নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে বেশ উদাসিন। 

১২। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা: মহিষের চারণভূমি হিসাবে বিবেচিত উপকূলীয় চরাঞ্চলগুলো সাধারণত মূল ভূখন্ড থেকে গড়ে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে। বিশেষ করে ভোলা জেলায় কমবেশি ৩৪টি চর রয়েছে। বেশিরভাগ চর মূলভূখন্ড থেকে গড়ে ৫-৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মূলভূখন্ড থেকে চরে যাতায়াতের জন্য  নৌপথ হচ্ছে একমাত্র পথ, যেখানে যেতে  ট্রলার অথবা স্প্রীডবোট ব্যবহার করতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে এসব চরে যেতে গড়ে ১-২ ঘণ্টা, বষা মৌসুমে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে, এমন কি কোন কোন চরে যেমন: সদরের মাঝেরচর, চরফ্যাশনের চরহাসিনা ও চরনিজাম, মনপুরার বদনার চর ও কলাতলীর চর, লালমোহনের চরলক্ষী ইত্যাদিতে যেতে ৩-৪ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। বেশি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হলে এসব চরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, অনেক সময় যাওয়া যায় না। এছাড়া অধিকাংশ চরে (প্রায় ৯০%) জনমানবের বসতি নেই।  ফলে এসব চরে অধিকাংশ সময় (প্রায় ৯০%) মহিষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সেবা হাতের নাগালে পাওয়া যায় না এবং একই কারণে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যয় এসব চরে প্রাণিসম্পদের তেমন কোন প্রযুক্তি/পদ্ধতি সম্প্রসারিত হয়নি।

১৩। প্রাকৃতিক দুর্যোগ: উপকূলীয় চরাঞ্চলে মহিষ পালনের অন‍্যতম অন্তরায় হচ্ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। বিশেষ করে হঠাৎ বন‍্যা, অতি বন‍্যা, অনাবৃষ্টি, বজ্রপাত, জলোচ্ছ্বাস মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে প্রায় প্রতি বছর অনেক মহিষ মারা যায় । বিগত ৫ বছরে এক ভোলা জেলাতেই বজ্রপাতে আনুমানিক  ২০০-২৫০ মহিষ, অতি বন‍্যায় পানিতে ভেসে ৫০০-৭০০ মহিষ, হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসে পানিতে ডুবে/কিল্লাতে আশ্রয় না পেয়ে ৮০০-১০০০মহিষ এবং অনাবৃষ্টিতে মাঠে ঘাস না থাকার কারণে ৩০০-৪০০ মহিষ মারা গেছে বলে জানা যায়। এছাড়া এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মহিষের খাদ্য সংকটের অন্যতম কারণ।

১৪। সুপেয় পানির অভাব:  চরে বাথানে পালিত মহিষ এবং মহিষের রাখালদের খাওয়ারযোগ্য পানির একমাত্র উৎস প্রধান নদী মেঘনা, তেতুলিয়া থেকে চরের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসা অসংখ্য ছোট ছোট ক্যানেল। এই সব ক্যানেলের পানি সাধারণ মিষ্টি (সুপেয়) হয়ে থাকে কিন্তু হঠাৎ বন্যা/জলোচ্ছ্বাসে অথবা অতি বন্যায় পানির সাথে অতিরিক্ত লবন এই সব ক্যানেলে ঢুকে পড়ে পানি মহিষের খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে/শীত মৌসুমে (নভেম্ভর-মার্চ) এসব ক্যানেলে পযাপ্ত পানি থাকে না। তখন বাথানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়, এতে করে অনেক মহিষ বিশেষ করে বাচ্চা মহিষ মারা যায়। পাশাপাশি একই কারণে বড় মহিষের উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ব্যহৃত হয়।
 
১৫। নাইট্রেট পয়জনিং: স্থানীয় মহিষ পালনকারীদের মতে প্রতি বছরে অনেক মহিষ মারা যায় ডায়রিয়ার কারণে এবং বাথানে প্রায় সময় অধিকাংশ মহিষ ডায়রিয়াতে ভুগে থাকে (প্রায় ৪০-৫০% মহিষ)। প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোর পরেও ডায়ারিয়া সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয় না। অনুসন্ধান করে দেখে গিয়েছে, বাথানে ডায়ারিয়া হওয়ার অন্যতম কারণ, নাইট্রেট পয়জনিং। আবার এই নাইট্রেট পয়জনিং হওয়ার অন্যতম কারণ চরের জমিতে তরমুজ চাষ। যখন তরমুজ চাষ করা হয়, তখন জমিতে প্রচুর ইউরিয়া, টিএসপি ইত্যাদি রাসায়নিক সার ব্যবহার করা দ্রুত তরমুজ ফলানের জন্য। ৩ মাস মেয়াদি এই তরমুজ যখন চর থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে তোলা হয় তখন সেই জমিতে প্রচুর রাসায়নিক সার থেকে যায়। ফলে এই ধরণের জমিতে বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টির পানি/জোয়ারের পানি পড়ার সাথে সাথে দ্রুত প্রচুর তরতাজা কাচাঘাস জন্মে। এই ঘাস খেয়ে চরে সাধারণত মহিষ নাইট্রেট পয়জনিং-এ আক্রান্ত হয়ে থাকে ।
 
১৬। দুধ বাজারজাতকরণে সমস্যা: উপকূলীয় জেলাগুলোতে বিশেষ করে ভোলা জেলার অধিকাংশ চরগুলো সাধারণত মূল ভূখন্ড থেকে গড়ে ৩-৪ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত এবং নৌপথে ট্রলার অথবা স্প্রীডবোট যেতে হয়। সাধারণত এসব চরে দলগতভাবে ৪-৫জন গোয়ালা মিলে ১টি ট্রলার নিয়ে ৫-৬টি চরের ৮-১০টি বাথান থেকে দৈনিক গড়ে ৪০০-৫০০লিটার  দুধ সংগ্রহ করে থাকে। এসব চরে একটি ট্রলার একবার যাতায়াতে গড়ে ২-৩ হাজার টাকা এবং স্পীডবোটে গড়ে ৭-৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়ে থাকে। যা একদিকে খুবই ব্যয়বহুল, অন্যদিকে দুর্গম, সময় সাপেক্ষ এবং রিস্কি হওয়ার কারণে মুলভূখন্ড থেকে একাকি গোয়ালাদের চরে যাওয়া অথবা চর থেকে মালিকদের পক্ষে মূল ভূখণ্ডের দুধের বাজারে/দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে দুধ নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে দলবদ্ধ গোয়ালাদের নিকট খামারীদের অনেকটা জিম্মি থেকে তুলনামূলক বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে দুধ বিক্রি করতে হয়। এছাড়া এসব চরে অধিকাংশ মালিক গোয়ালাদের কাছে সারা বছর দুধ বিক্রি করবে বলে এক ধরণের মৌখিক চুক্তির মাধ্যমে মহিষ প্রতি দাদন নিয়ে থাকে (গোয়ালারা সাধারণত একটি দুধালো মহিষ প্রতি বাৎসরিক গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা দাদন দিয়ে থাকে, একজন দাদনদারকারী গোয়ালাকে মালিক/বাথান প্রতি ২০,০০০ থেকে ১৪ লাখ পর্যন্ত দাদন দেয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে, এ অঞ্চলে সাধারণত দাদন -collateral free দেয়া হয়)। একদিকে দূর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্যদিকে দাদন গ্রহণ। এ দুটি কারণে চরে খামারীদের দুধের মূল্য নিধারণে অনেকটাই গোয়ালাদের উপর নির্ভর করতে হয়। এসব কারণে চরে খামারীরা মুলভূখণ্ডের অবস্থিত দুধের মূল্য থেকে ৩০-৪০ ভাগ কম মূল্য পেয়ে থাকে। চরে গোয়ালারা বাৎসরিকভাবে লিটার প্রতি দুধের মূল্য গড়ে ৬৫-৭০ টাকা করে দিয়ে থাকে অথচ মূলভূখন্ডের বাজারে লিটার প্রতি দুধের গড়ে ১০০-১২০টাকা হয়ে থাকে, পিক সিজনে গড়ে ১৩০-১৫০টাকা থাকে (পিক সিজন: নভেম্বর-মাচ মাস পর্যন্ত) এবং অপ সিজনে গড়ে ৮০-৯০টাকা থাকে (অপ সিজন: এপ্রিল-অক্টোবর মাস পর্যন্ত)।

১৭। মহিষ বাজারজাতকরণে সমস্যা: উপকূলীয় জেলাগুলোতে বিশেষ করে ভোলা জেলার অধিকাংশ চরগুলোতে যে সব কারণে মহিষের মালিকরা দুধ বাজারে নিয়ে আসে না ঠিক সেই সব কারণেই মহিষও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যয় প্রচলিত গরু/মহিষের হাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে না (প্রায় ১০০% মালিকগণ) । ফলে মহিষ বিক্রির ক্ষেত্রেও এক শ্রেণির দালাল/বেপারিদের উপর তাদের নির্ভর করতে হয়। এসব দালালরা দলগতভাবে মহিষের মালিকদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে চরে ট্রলার নিয়ে গিয়ে দরদাম করে বড়লটে (একসাথে ৮-১০টি) বাথানগুলো থেকে মহিষ ক্রয় করে। প্রধানত পুটয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কালাইয়া গো-মহিষের হাটে (বরিশাল বিভাগের সর্ববৃহৎ মহিষের হাট) নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বড় বড় বেপারিদের নিকট বিক্রি করে থাকেন। এছাড়া স্থানীয়ভাবে কিছু মহিষ মাংসের জন্য জবাই হয়, তবে তা গো-মাংসের ন্যয় নিয়মিত জবাই হয় না। এসব কারণে মহিষের মালিকগণ দুধের ন্যয় লাইভ মহিষ বিক্রির ক্ষেত্রেও  বাজারমূল্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কমমূল্য পেয়ে থাকে (১০-১৫% কম মূল্য পায়)। সাধারণত এসব দালালগণ মালিকদের নিকট থেকে একটি প্রাপ্তবয়স্ক মহিষ গড়ে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে হাটে নিয়ে গড়ে  ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিক্রি করে মহিষ প্রতি গড়ে ১০-২০ হাজার টাকা লাভ করে থাকে।
 
১৮। প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতার অভাব: উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে ভোলাতে মহিষের দুধের মোট উৎপাদন কম এবং দেশব‍্যাপি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রেতা/পণ‍্যের চাহিদা না থাকার কারণে ভোলাতে মহিষের দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাস্তুরিত প্যাকেটজাত তরল দুধ এবং অন্যান্য বৈচিত্র্যময় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের জন‍্য মিল্ক ভিটা, প্রাণ, আড়ং, ফ্রেশ এর মতো প্রাইভেট কোম্পানি এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। অনুরুপভাবে দেশব্যাপী মহিষের মাংসের চাহিদা না থাকায় মহিষের ফ্রোজেনসহ অন্যান্য মাংসজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের জন‍্য বেঙ্গল মিটের মতো কোন প্রাইভেট কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 

১৯। জাতীয় বাজারের এ্যাক্টরদের সাথে লিংকেজের অভাব: উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে ভোলাতে মহিষের দুধ এবং এ দুধ থেকে তৈরি বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ‍্যের (মোট ঊৎপাদিত দুধের ৭০ ভাগ টক দই, ২৫ ভাগ মিষ্টি জাতীয় পণ্য, এবং ৫ ভাগ ঘি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়) ৯০ ভাগ স্থানীয়ভাবে কনজিউম হয় এবং অবশিষ্ট মাত্র ১০ ভাগ ভোলার বাহিরে বিক্রি হয়। এখন পর্যন্ত কোন প্রাইভেট কোম্পানি বা প্রাতিষ্ঠানিক চ‍্যানেলের মাধ‍্যমে মহিষের দুধের তৈরি এসব দুগ্ধজাত পণ্য জাতীয় মার্কেটে বিক্রি হয় না। অনুরুপভাবে মাংসের জন‍্য উৎপাদিত মহিষের মাত্র ১০ ভাগ স্থানীয়ভাবে জবাই হয়ে থাকে তাও আবার বিভিন্ন মৌসুমে, ৭০ ভাগ লাইভ মহিষ চট্টগ্রামে এবং অবশিষ্ট ২০ ভাগ মহিষ দেশের অনান‍্য অঞ্চলে বিদ্যমান অপ্রাতিষ্ঠানিক চ‍্যানেলে চলে যায়। দুধের মতো মাংস বিক্রির জন‍্যই ভোলাতে কোন প্রাতিষ্ঠানিক মার্কেট/কোম্পানীর অস্তিত্ব নেই। উপকূলীয় অঞ্চলে শুধু ফ্রেশ মিট বিক্রি হয়, ফ্রোজেন মিটের কোন বাজার নেই। অথচ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশে বতর্মানে বাৎসরিক প্রায় ১২০০টনের মতো ফ্রোজেন বাফেটো মিট বিক্রি হচ্ছে, যা ভারত থেকে আমদানী হয়ে থাকে।
 
২০। মহিষের মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যের ইতিবাচক প্রচার-প্রসারের অভাব: বিভিন্ন মিডিয়াতে ইতিবাচক প্রচার-প্রসারের অভাবে দেশব্যাপী সকল শ্রেণির ক্রেতার মাঝে মহিষের মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের গুনাগুন নিয়ে এক ধরণের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। যার কারণে গো-মাংস, গরুর দুধ এবং গো-দুধের তৈরী বৈচিত্র্যময় পণ্যের ন্যায় দেশব্যাপী মহিষের মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য সকল শ্রেণির ক্রেতার নিকট ততোটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। 

উপকূলীয় অঞ্চলে মহিষ সেক্টরে বিদ্যমান এ সকল সমস্যা হ্রাসকল্পে পিকেএসএফ ২০১৬ সাল থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের ৪টি সহযোগী সংস্থার (এনজিও)মাধ্যমে বিভিন্ন ভ্যালু চেইন কমকাণ্ড বাস্তবায়ন করে আসছে, যা বতর্মানে সহযোগী সংস্থা জিজেইউএস ও এফডিএ মাধ্যমে চলমান রয়েছে (মহিষ সেক্টর উন্নয়নে পিকেএসএফ-এর অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিস্তারিত আকারে পরবর্তীতে আসছে)। পিকেএসএফ ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি পযায়ে ডিএলএস ও বিএলআরআই হতেও বতর্মানে কিছু কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে এ সেক্টরের বহুদিন ধরে চলে আসা এ সকল সমস্যা সমাধানে দরকার সরকারি -বেসরকারি সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বড় উদ্যোগ তবেই এ সেক্টরে আসবে গতিশীলতা, বাড়বে মহিষের উৎপাদনশীলতা, সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান এবং বৃদ্ধি পাবে দেশের পুষ্টি যোগান।

লেখক: উপ-ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ।

বিভি/কেএস

মন্তব্য করুন:

Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2