• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

এবছর শেষ হচ্ছে না ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হবে বিশ্বে

মনজুরুল হক

প্রকাশিত: ১৬:০৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ফন্ট সাইজ
এবছর শেষ হচ্ছে না ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হবে বিশ্বে

সংগৃহীত ছবি

জানুয়ারি মাসের শেষ তথ্য অনুযায়ী ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লক্ষ ইউক্রেন সেনা নিহত হয়েছে। আর্মস-অ্যামিউনিশনের খতিয়ান আরও বেশি লম্বা-চওড়া। এর পাশাপাশি ইউক্রেন পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে কী পরিমান সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে সেই খতিয়ান বিস্ময়কর! মার্কিন যুদ্ধাস্ত্র সহায়তার ইতিহাসে এক ইউক্রেনে যে পরিমান অস্ত্র, গোলাবারুদ, অর্থ সাহায্য এবং অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছে তার যোগফল আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, যুগস্লোভাকিয়াতে পাঠানোর লজিস্টিকের চেয়েও বেশি। তারপরও প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি একটার পর একটা ভিডিও বক্তৃতায় সাহায্য চেয়ে চলেছেন। তার চাহিদা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ন্যাটো আর পশ্চিমা ইন্ডিভিজ্যুয়াল রাষ্ট্রগুলো সাপ্লাই অব্যহত রেখেছে। একটা দেশকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর এই সম্মিলিত অস্ত্র-লজিস্টিক সহযোগিতা বিশ্বের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি। সঙ্গত প্রশ্ন উঠবে-কেন? তারা কি যুদ্ধ থামাতে চাইছে? মোটেও না। তারা যুদ্ধটাকে টেনে নিয়ে ‘রাশিয়া বনাম ন্যাটো’ ক্যাটাগরিতে ফেলে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করে রাশিয়াকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার নিশ্চিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাই এখন আর ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ার সামরিক অভিযান বলে দাড়ি টানার সুযোগ নেই। এটা এখন প্রমাণিত ‘রাশিয়া-ন্যাটো যুদ্ধ’, যা কারেন্ট রেঞ্জে থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের প্রক্সি। বিপজ্জনক সত্য হচ্ছে এই প্রক্সিটা যে কোনো সময় অলআউট থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার-এ রূপ নেবে। সম্ভবনা নয়, এটাই এখনকার নির্মম বাস্তবতা।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খারাপ খবর-রাশিয়া শেষ পর্যন্ত লড়াই করে:
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি কমিশনার জোসেপ বোরেল বলেছেন—পশ্চিমাদের অবশ্যই কিয়েভে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। যারা মনে করে রাশিয়া পরাজিত হচ্ছে বা যুদ্ধবিরতী চাইছে, তাদেরকে সতর্ক করে বলতে চাই- মস্কোর দীর্ঘ যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস রয়েছে। মস্কো নেপোলিয়ন এবং হিটলারের মত প্রবল পরাক্রমশালীদের পরাজিত করেছে। সে কারণে পশ্চিমকে অবশ্যই ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।

বোরেল যে এই সতর্কবাণী দিলেন, সেটা কেন? কারণ তিনি এবং তার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে বিশদে তো জানেনই, সেই সঙ্গে এটাও জানেন রাশিয়া ইউক্রেনে হুট করেই সামরিক অভিযান পরিচলনা করতে আসেনি। এর পেছনে গত কয়েক বছরের নিখুঁত প্রস্তুতিও আছে তাদের।

নেপোলিয়ন একটি বহুজাতিক সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যা সমস্ত ফরাসী-অধ্যুষিত ইউরোপ থেকে নিয়োগ করেছিল এবং মস্কোতে পৌঁছেছিল, কিন্তু রাশিয়াকে আত্মসমর্পণ করাতে ব্যর্থ হয়েছিল। দুই বছর পর প্যারিসের রাস্তায় রাশিয়ান অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শেষ হয় নেপোলিয়ানের পরাজয়ে। হিটলারেরও একই পরিণতি হয়েছিল। তার বিশ্বজয়ী বাহিনী যা সে সময়কার রাশিয়া, ব্রিটেন, তুরস্কর সম্মিলিত সামরিক শক্তির চেয়েও বেশি ছিল। সেই বাহিনী নিয়ে প্রবল পরাক্রমশালী হিটলাকেও মাথা নত করে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে। অপমানে-ক্রোধে আত্মহত্যা করতে হয়েছে।

ইইউ, ন্যাটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তলে তলে ইউক্রেনকে যত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সাহায্য দিক না কেন, যুদ্ধটা করবে কিন্তু ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। তবে এখন ইউক্রেনীয় বাহিনী খানিকটা জানে পানি পেয়েছে, কারণ তাদের প্রভু পশ্চিমা শক্তি এখন আর রাখ-ঢাক করছে না, সোজাসুজি ইউক্রেনে ন্যাটো সৈন্য নামিয়েছে সামরিক বিশেষজ্ঞর কাভারে।

 মার্কিনের ‘অপারেশন স্যাবোটাজ’-‘রাশিয়ান অ্যাকশন কমিটি’:
সম্প্রতি ব্যাপরটা চাউর হলেও মূল পরিকল্পনা সেই ১৯৪৫ সাল থেকেই। সেটা কী? সোভিয়েত ইউনিয়নে অস্থিরতা সৃষ্টি করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ভেঙে সোবিয়েত সহায়তায় বিশ্বজুড়ে গড়ে ওঠা সমাজতান্ত্রিক ব্লক ভেঙে দেওয়া। এই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় লেনিন পরবর্তী স্তালিন জমানায় স্তালিনকে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে শেষে এসে ফলবতী হয় ১৯৯১ সালে গর্বাচেভকে ‘কিনতে’ পেরে। গর্বাচেভ মার্কিনীদের ‘কেনা গোলাম’ হয়ে একে একে সোভিয়েতকে ক্ষমতাহীন করে, জোটবদ্ধ রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত ছেড়ে বেরিয়ে যায়, শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এর পরেও মার্কিন অক্ষ শক্তি রাশিয়াকে ভাঙতে চায়, কারণ ১৯৯১ সালের শক্তিহীন রাশিয়া এখন আগেকার সোভিয়েতের মতই পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছে। বর্তমানের ইউক্রেন হচ্ছে মার্কিনীদের সেই ‘রেসের ঘোড়া’। ইউক্রেন করায়ত্ব করেই মার্কিন অক্ষশক্তি রাশিয়াকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে চায়, কারণ রাশিয়া যতো দিন শক্তিশালী থাকবে তত দিন ইউরোপে মার্কিনের দাদাগিরি সহজ হবে না।

রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করার পর পরই রাশিয়াকে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি। এবার ‘ফ্রিজড’ অবস্থায় থাকা ‘স্যাবোটাজ তত্ত্ব’ বা রাশিয়াকে টুকরো টুকরো করার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তাদের প্রজেক্টের নাম ‘রাশিয়ান অ্যাকশন কমিটি’। এই অ্যাকশন কমিটির কাজ রাশিয়ার ক্ষমতার পালা বদল। মার্কিন ‘নীলনক্সা’ অনুযায়ী রাশিয়ায় পুতিনবিরোধী একটি শক্তিশালী দল গড়ে তোলা হয়েছে। যারা পুতিনকে পদত্যাগে বাধ্য করবে। পুতিনের পতনের পর ক্ষমতায় আসবে প্রাক্তন দাবাড়ু গ্যারী কাসপারভ ও মিখাইল খদরকভস্কি। এর পর ছেলের হাতের মোয়ার মত রাশিয়া ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে শান্তিচুক্তি করবে। ইউক্রেন যুদ্ধের যাবতীয় ক্ষতিপুরণ দেবে। ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের দখল করা চারটি অঞ্চল ছেড়ে দেবে। ১৯৯১ সালের সীমানা মেনে চলবে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী ছোট করে আনবে। ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস ও সেন্ট্রাল ফর কম্ব্যাটিং এক্সট্রিমিজম বিলুপ্ত করা হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ করা রুশ যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতে তুলে বিচার করা হবে। রাশিয়া ভেঙে কয়েকটি খন্ড করে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। এবং রাশিয়া এখনকার আর্মেনিয়া বা জর্জিয়ার মত একটি শক্তিহীন মার্কিন তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তাবেদার দেশ হিসাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে।

এই ‘ছেলের হাতের মোয়া’ কিংবা ম্যানহাটনের ‘ইনস্ট্যান্ট বার্গারটি’ মুখে পোরার জন্য মার্কিনীরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। অপরদিকে রাশিয়া কী করছে? মস্কোতে বসেই পুতিন মার্কিন নির্বাচন ঘুলুট করে দিয়েছেন। এখনকার রাশিয়া ১৯৯১ সালের মাজা-ভাঙা হতভম্ব রাশিয়া নয়। পুতিন রেড বাটনে চাপ দিলে একযোগে ১৬টি করে সারমাট আমেরিকার ১৬টি শহর ধ্বংস করতে রওনা দেবে। দিমিত্রি মেদভেদভ অনেক আগেই ডিক্লেয়ার করে দিয়েছেন ন্যাটোর সঙ্গে কোনো ‘মুন্নি-মুন্নি খেলা’ হবে না। যা হবে ‘বড়দের খেলা’। ঈঙ্গিতটা পরিষ্কার। এবার যুদ্ধ হবে নিউকে নিউকে। নো ট্রাডিশনাল ম্যানুয়াল ওয়ারফায়ার। আর ক্ষমতায় এখন মিখাইল গর্বাচেভ নয়, ভ্লাদিমির পুতিন। 

 ২০২৩ রাশিয়ার জন্য মেক-অর-ব্রেক বছর-দিমিত্রি ট্রেনিন:
অর্থনীতির উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন গবেষণা অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের প্রধান গবেষণা ফেলো দিমিত্রি ট্রেনিন, যিনি রাশিয়ান আন্তর্জাতিক বিষয়ক কাউন্সিলের সদস্যও, তিনি এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন ২০২৩ সাল রাশিয়ার জন্য কেন ‘মেক-অর-ব্রেক’ বছর? ট্রেনিন বলেছেন—“বিশেষ করে অস্থির সময়কালে রাজনৈতিক ঘটনার গতিপথের ভবিষ্যদ্বাণী করা একটি ভয়ানক অর্থহীন প্রচেষ্টা। 

ইউক্রেনের সংঘাত যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, রাশিয়া এবং মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে এটি একটি মীমাংশাহীন দ্বন্দ্বের মতো বিকাশ হবে। শত্রুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাকি সব পক্ষের জন্য অত্যন্ত রিস্কি, সেটা মস্কোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিম ইউরোপের চেয়েও বেশি। রাশিয়ার জন্য সংঘাত শুধুমাত্র বাহ্যিক নিরাপত্তা এবং বিশ্বে তাদের অবস্থানের শংকা নয়, বরং রাজনৈতিক শাসনের সমন্বয় এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রের ভবিষ্যতসহ অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার বিষয়ও বটে।  

সব দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত চুক্তির ফলে শেষ হয়। এই পরিস্থিতি ১৯৫০-এর দশকের কোরিয়ান চুক্তির মতো একটি শান্তি চুক্তি বা এমনকি একটি স্থিতিশীল যুদ্ধবিরতির উপসংহারে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। সমস্যা হল ওয়াশিংটনের সর্বোচ্চ ছাড় মস্কোর ন্যূনতম লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল বিশ্বশক্তির গ্রুপ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া, মস্কোতে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করা এবং চীনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদারি থেকে বঞ্চিত করা। এদের কৌশল হল যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে নিঃশেষ করা, বিশ্ব সমাজকে নাড়া দেওয়া, রাশিয়ার শাসকদের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করা এবং অবশেষে ক্রেমলিনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। 

এর বিপরীতে রাশিয়ার জন্য এই দূরভিসন্ধী বুঝে ভবিষ্যতে আরেকটি সশস্ত্র সংঘাত এড়ানোর জন্য তার লক্ষ্যগুলো অর্জন করা, যে শক্তি এবং সম্পদ তাদের রয়েছে। সে হিসাবে ২০২৩ সালে ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ নাও হতে পারে। যদি তাই বিশ্বজুরে অর্থনৈতিক সংকট বিশেষ করে খাদ্য সংকট আরো তীব্রতর হবে।

 

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার  বাংলাভিশন নিবে না।)

মন্তব্য করুন: