দেশের রাজনীতিতে একজন খালেদা জিয়া হয়ে ওঠার গল্প

লন্ডনে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। চার মাসের চিকিৎসায় অনেকটা ভালো বোধ করায় দেশে ফিরছেন তিনি। আগেও চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরলেও এবারের ফেরাটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে দেশের রাজনীতি এবং জনগণের কাছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে শহীদ হন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
স্বামীর শাহাদাতের আগ পর্যন্ত গৃহবধূই ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। দুই ছেলেকে লালন-পালন ও ঘরের কাজ নিয়েই সময় কাটাতেন। জিয়াউর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর বাস্তবতা তাকে টেনে আনে রাজনীতিতে। নেতা-কর্মীদের আহ্বানে ধরতে হয় দলের হাল। সেই থেকে শুরু .....।
১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন। পরের বছর মার্চে তিনি হন দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হলে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাকে করা হয় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। বিচারপতি সাত্তারের মৃত্যুর পর সেই বছরের ১০ মে চেয়ারপারসন পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি। কারাভোগসহ নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নির্যাতনকে সঙ্গী করে এ দায়িত্বে আছেন টানা চার দশক।
দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরই নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। তারপরও দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন কঠিন আন্দোলন। পান আপসহীন-দেশনেত্রীর খ্যাতি। এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে কোনোরকম সমঝোতা না করেই আন্দোলন করে গেছেন। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলেও বর্জন করে বিএনপি। যা দেশবাসীর কাছে আপসহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৮৭ সাল থেকে বেগম খালেদা জিয়া এরশাদ হটাও- এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার ও ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন করে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বার এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের দশম কাউন্সিলে চতুর্থবারের মতো বিএনপির চেয়ারপারসন হন।
নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে- পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই তিনিই জয়ী হয়েছেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনি লড়াই করে সবকটি মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তিপান। কারাগারে থাকাকালে তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যেতে অস্বীকার করেন। পরের বছর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি হাইকোর্টের আদেশে মুক্তিপান।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হন। ওয়ান ইলেভেন সরকারের দায়ের করা বিতর্কিত এক মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। প্রথমে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে নিয়ে রাখা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে।
এরপর একই বছরের এপ্রিলে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নেওয়া হয় রাজধানীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে। সেদিন গাড়ি থেকে হেঁটে নামতে দেখা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। এখন পর্যন্ত এটিই ছিল গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে চলার শেষ দৃশ্য। এরপর ক্রমেই অসুস্থ হতে থাকেন বেগম খালেদা জিয়া।
২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নির্বাহী আদেশে বেগম জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়। ২৫ মার্চ বেগম খালেদা জিয়াকে যখন হাসপাতাল থেকে বের করা হচ্ছিল, তখন খুবই অসুস্থ ছিলেন তিনি। হাঁটাচলার মতো পরিস্থিতিও ছিল না তার। হুইল চেয়ারে করে তোলা হয় গাড়িতে।
সেই অবস্থায় নেতা-কর্মী বেষ্টিত হয়ে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছান খালেদা জিয়া। এরপর থেকে বাসায় থেকে দেশেই চিকিৎসা নিতে হয় তাকে।
এরমধ্যে পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানানো হলে, সরকার বারবার নাকচ করে দেয়।
বেশ কয়েকবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। ২০২১ সালের এপ্রিলে আক্রান্ত হন করোনায়। ধীরে ধীরে আরেও কিছু গুরুতর রোগে আক্রান্ত হন তিনি। দেখা দেয় জটিলতা।
এরমধ্যে লন্ডনে অবস্থান করা ছেলে তারেক রহমান বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মায়ের চিকিৎসা ও মুক্তির জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান। মুক্তির জন্য রাজনৈতিকভাবে নানা কর্মসূচিও পালন করা হয়।
টানা গত ৬-৭টি বছর বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়েই ছিল দেশের বড় দল বিএনপির অন্যতম দুশ্চিন্তা। নানা আন্দোলন সংগ্রামেও নিশ্চিত করা যায়নি তার বিদেশে চিকিংসা। ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুথানে শেখ হাসিনার পলায়নের পর খালেদা জিয়ার বন্দি জীবনের অবসান হয়। এরপর এ বছরের ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় লন্ডনে।
সেখানে দ্য লন্ডন ক্লিনিকে ১৭ দিন চিকিৎসার পর গত ২৫ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে ছেলে তারেক রহমানের লন্ডনের বাসায় যান তিনি। এরপর ছেলের বাসাতেই তার চিকিৎসা চলে। চিকিৎসায় শারীরিকভাবে আগের চেয়ে অনেকটা ভালো বোধ করায় দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত।
তার এই ফিরে আসা নতুন নয়, ৪০ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নিজের চিন্তা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি খালেদা জিয়া। আপসহীনতাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাকে নিয়ে গেছে ভিন্ন উচ্চতায়।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: