• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪

আড়াইশো কোটি টাকার প্রকল্প শেষেও গতি ফিরেনি কুমার নদে

হারুন আনসারী, ফরিদপুর

প্রকাশিত: ১৩:৩৩, ১৪ মার্চ ২০২৩

ফন্ট সাইজ
আড়াইশো কোটি টাকার প্রকল্প শেষেও গতি ফিরেনি কুমার নদে

২৫০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে পুনঃখনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও গতি ফিরেনি কুমার নদের। নদী পুনঃখনন কাজ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলেনি। নদীর সংস্কার কাজে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীটিকে একটি বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিলো। তবে কাজ শেষেও নদীতীরের দুইপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা যায়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে, খনন কাজের সময় নদী তীরে ধ্বস নামায় শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদের প্রায় দুই কিলোমিটার পুনঃখনন কাজ বাস্তবায়ন করা যায়নি। অন্যদিকে, শহরের বাইরে যেসবস্থানে খনন করা হয়েছে, এরইমধ্যে সেখানকার অনেকস্থানে মাঝনদীর বুকে চর পড়ে গেছে। অনেকস্থানে খাড়াভাবে ভেকু দিয়ে খনন করায় নদীর তীরে দেবে গেছে। এসব কারণে দেশের অন্যতম এই বৃহৎ নদীটি বর্তমানে অনেকস্থানে অস্তিত্বসঙ্কটে রয়েছে। আর শহর ফরিদপুরের অক্সিজেন ভান্ডার এই কুমার নদ দখল ও দুষণে জরাজীর্ণ ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় শহরবাসী দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদ বিপুল ময়লা-আবর্জনা আর দখলে দূষিত হয়ে উঠেছে।  শহরের ব্যস্ততম এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই কুমার নদের ঘাটলাগুলো যেনো এখন বাজার ও বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনার ভাগাঢ়।


ফরিদপুর হয়ে গোপালগঞ্জের আড়িয়াল খাঁ ও মধুমতি নদীতে পৌছে মিশেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই কুমার নদ। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে এর উৎপত্তি। সবমিলিয়ে প্রায় ১২৪ কিলোমিটার লম্বা। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৬ সালের জুলাইতে ২৫০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে মূল কুমারের ৭১ কিলোমিটার অংশ সংস্কারে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কাজটি খুলনা শিপইয়ার্ড পাওয়ার পরে সেটি সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে বাস্তবায়ন করে বেঙ্গল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফিউচার ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ২০১৯ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করা হয়। পুন:খনন ছাড়াও নদীতে গোসলের জন্য বিভিন্নস্থানে ৬১টি পাকা ঘাট ও নারীদের পোশাক পরিবর্তনের জন্য ঘাটের পাশে ঘর নির্মাণ করে পর্যায়ক্রমে নদীকে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা ছাড়াও এ প্রকল্পের মাধ্যমে কুমার নদে ১০ কোটি ঘনমিটার পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার কথা। এতে ২৩ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে সেচসুবিধা দিয়ে ৩৪ হাজার ১০৪ হেক্টর টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদন হবে বলে পাউবো জানায়।
বাস্তবে দেখা গেছে, শহরের বুকে কুমার নদ পুনঃখননে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় অবৈধ দখলদারদের কারণে। 

নদের দুই পারে শহরের ভেতরকার ৯ কিলোমিটার অংশে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখলদারদের কবলে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, অন্তত ১ হাজার ৬০০ অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে দুই পারে। শহরের মদনখালী রেগুলেটরের নিকট উৎস মুখ থেকে শুরু হয়ে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এলাকা পর্যন্ত সর্বত্র দখলের চিহ্ন। মদনখালী রেগুলেটর, চুনাঘাটা, অম্বিকাপুর, আলীপুর, শরীয়তুল্লাহ বাজার, পশ্চিম খাবাসপুর, পূর্ব খাবাসপুর, চর কমলাপুর ও বিলমামুদপুরে নদের দুই পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা চলে গেছে দখলদারদের কবজায়। এরমধ্যে অনেক জায়গা সিএন্ডবি, পৌরসভা কিংবা জেলা পরিষদের মালিকানাও রয়েছে। যেগুলো অপসারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। 


ফরিদপুর শহর গড়ে উঠেছে এই নদের দুই পারে। উভয় অংশের যোগাযোগের জন্য চুনাঘাটা, উত্তর আলীপুর, অম্বিকাপুর, আলীপুর, তিতুমীর বাজার ও শরীয়তুল্লাহ বাজারের মাঝখানে, পূর্ব খাবাসপুর ও চরকমলাপুরে সাতটি সেতু রয়েছে। এসব সেতুর তলদেশে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে নদী তীর। সেখানে ময়লা ফেলে স্তুপ করে রাখা হয়েছে।
শহরের মধ্যে কুমার নদটি সবচেয়ে বেশি দখল ও দুষণের শিকার দুই পাড়ে অবস্থিত দুটি বৃহৎ বাজার হাজি শরিয়তুল্লাহ বাজার ও সরকারি তিতুমীর বাজারের নিত্যদিনের বর্জ্য ফেলার কারণে। নদী দখল করে বসতবাড়ি, দোকানপাট ও মসজিদ-মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ইটভাটা, বেকারিসহ ছোট ও মাঝারি কারখানা এমনকি পৌরসভার গণশৌচাগারও। বাজার এলাকায় কাঁচা শাকসবজির বর্জ্য, কারখানার বর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, গেরস্থালি বর্জ্যসহ হেন কোনো আবর্জনা নেই, যা কুমারের বুকে ফেলা হচ্ছে না। সারা শহর থেকে বয়ে আনা পৌরসভার ড্রেনের ময়লা পানি বড় বড় ৬টি স্থান দিয়ে ফেলা হচ্ছে কুমার নদে। এসব ড্রেনের সঙ্গে কোনো কোনো বাড়ির পয়োনালার সংযোগ থাকায় মলমূত্রও এসে পড়ছে কুমার নদে। পাশাপাশি মাছ ধরা ও চাষের জন্য মাঝে মাঝে বাঁশের খুঁটি ও জাল দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। খননযন্ত্র বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হচ্ছে নদীর গহ্বর থেকে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় কচুরিপানা জমে এঁদো ডোবার মতো হয়েছে কুমারের চেহারা। শহরের আলিমুজ্জামান বেইলী ব্রিজ থেকে পশ্চিম খাবাসপুর নার্সিং ইন্সটিটিউট পর্যন্ত কুমার নদের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পরিণত হয়েছে মশার জন্মস্থানে। মাঝে মাঝে নদে মাছ মরে ভেসে ওঠার ঘটনাও ঘটছে। নদী পুনঃখনন প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নের পরেও এর উন্নয়ন হয়নি।

ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোস বলেন, শহরের বুকে কুমার নদে বাসাবাড়ি ও বাজারের বর্জ্য না ফেলার জন্য আমরা নদীর পাড়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সকলকে নিষেধ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, তা সত্ত্বেও যেসব কলকারখানা ও বাসাবাড়ির যেসব বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারেও চেষ্টা চলছে যাতে এভাবে নদীতে না ফেলতে পারে। কিছু প্রভাবশালীর বাসাবাড়ির ড্রেনও ইতোমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছি। আর শহরের ড্রেনের মুখগুলোর বিকল্প পথ খুঁজে বের করার বিষয়টি অর্থসাপেক্ষে বাস্তবায়নের বিষয়। এবিষয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে।
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা বলেন, কুমার নদ পুনঃখনন প্রকল্পের মূল খনন কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন নদীর ঘটনা নির্মাণসহ কিছু কাজ অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি বলেন, শহরের মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার কাজ করতে যেয়ে নদী তীর ধ্বসের ঘটনা ঘটে। একারণে এই অংশে পুনঃখনন কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। নদীর দুই তীরে দখলদারদের বিষয়ে তিনি জানান, প্রকল্প শুরুর পরে আমরা মেপে দেখতে পাই এসব স্থাপনা পৌরসভা, সিএন্ডবি কিংবা অন্যকোন বিভাগের। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা নেই।


ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা এব্যাপারে বলেন, কুমার নদ ফরিদপুরবাসীর জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নদকে ঘিরে ফরিদপুরবাসী অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে কুমার নদ পুনঃখননে প্রকল্পও হাতে নিয়েছিলো কিন্তু কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রকল্পের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই ফরিদপুরবাসীর স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। ফরিদপুরবাসীর প্রত্যাশা এই নদটি পুনঃখনন ও সংস্কার করে নাব্যতা বজায় রাখা হোক এবং স্রোতস্বিনী ধারা হিসেবে তার পূর্বের রূপ ফিরে পায় সেই ব্যবস্থা করা হোক।

মন্তব্য করুন: