• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

জৌলুস হারিয়েছে ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ি

অপূর্ব চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১৬:৩৭, ২৯ মার্চ ২০২৩

ফন্ট সাইজ
জৌলুস হারিয়েছে ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ি

জৌলুস হারিয়েছে ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ি

আধুনিকতার মাঝে এখনও টিকে আছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ি। তবে নানারকম সংকট আর পরিবর্তনের ফলে পুরনো জৌলুস হারিয়েছে টমটম খ্যাত ঘোড়ার গাড়ি। 

একসময় টমটম গাড়িতে প্রচুর লোকজন যাতায়াত করতো, গাড়িও ছিল অনেক। কালের বিবর্তনে সেই চিত্র যেন বিলুপ্ত হয়েছে। পরিবহনের আধিক্যতা, যানজট, ঘোড়া রক্ষণাবেক্ষণে মাত্রাতিরিক্ত খরচ, পর্যাপ্ত তদারকির ব্যবস্থা না থাকা-সহ বিভিন্ন কারণে টমটম গাড়ি হারিয়েছে তার পুরনো আমেজ। এর সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশই বিভিন্ন পেশায় যাচ্ছেন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে। আবার ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে অনেকেই টমটম গাড়ি চালিয়ে জীবিকাকে নির্বাহ করছেন।

জানা যায়, ১৮৩০ সালে পুরান ঢাকায় সর্বপ্রথম ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। জমিদারি বাহনের পাশাপাশি এটি সেসময় আর্মেনীয়দের ব্যবসার মালটানার কাজেও ব্যবহৃত হতো। এরপর নবাবি শাসনামলে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। 
পরে ধীরে ধীরে ঘোড়ার গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তবে এখন নবাবি ও জমিদারি শাসন না থাকলেও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের সাথেই মিশে আছে টমটম তথা ঘোড়ার গাড়ি। 

তবে বিগত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে নিজস্ব জৌলুস-আমেজ হারিয়েছে টমটম গাড়ি। টমটমের সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি সদরঘাট-গুলিস্তান রোডে আগে শতাধিক ঘোড়ার গাড়ি চলত। করোনার পর সেই সংখ্যা নেমে এসেছিল ২৫-৩০টিতে। কিন্তু এখন যাত্রীদের এক ধরনের বিমুখতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আবার অতি সম্প্রতি গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর স্থবিরতা নেমে আসে গুলিস্তান-সদরঘাট রুটে ঘোড়ার গাড়ি চলাচলে।

অন্যদিকে আগের তুলনায় এখন পরিবহন বেশি হওয়ায় এবং রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত যানজট থাকায় যাত্রীরা ঘোড়ার গাড়িতে কম চড়েন। আবার দ্রব্যমূল্যের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতির ফলে প্রতিটি ঘোড়া রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার খরচও বেড়ে গেছে। এতে করে কম আয়ের বিপরীতে বেশি হচ্ছে খরচ। উলটো এই পেশায় লেগে থাকতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে কোচোয়ান-হেল্পারসহ সংশ্লিষ্ট সবার। এসব কারণে বর্তমানে সর্বসাকুল্যে ১৫-২০টি ঘোড়ার গাড়ি সারাদিনে এই রুটে চলাচল করে।

আগে প্রতিদিন ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণে ৫০০-৬০০ টাকা খরচ হলেও এখন ১০০০-১২০০ টাকা খরচ হচ্ছে। প্রতিদিন মালিকের জমার টাকা উঠাতেই হিমশিম খেতে হয় বলে দাবি কোচোয়ান ও হেল্পারদের। এই অবস্থা চলতে থাকায় অনেকেই বাধ্য হয়ে সরে গিয়েছে। আর সবকিছুর সম্মিলিত প্রভাব পড়ছে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলনের উপর।

যারা এখনও সংযুক্ত রয়েছেন তাদেরও শঙ্কা- অচিরেই ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন একেবারে হারিয়ে যাবে বলে। তাই এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে ঘোড়ার পরিচর্যা খরচ কমানোর পাশাপাশি বিশেষ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি তাদের।

শুক্রবার দেখা যায়, পুরান ঢাকার বাংলাবাজার ফুটওভার ব্রিজের নিচ থেকে গুলিস্তান যাবার জন্য যাত্রীদের ডাকছেন কোচোয়ান ও হেল্পাররা। তবে দীর্ঘক্ষণ হাক ডাকের পর যাত্রীদের তেমন সাড়া পাচ্ছেন না তারা। সদরঘাট-গুলিস্তান যাওয়ার ভাড়া ৩৫ টাকা। প্রতিটি ঘোড়ার গাড়িতে মোট ১৫টি আসন থাকলেও ৫-৬ জন হলেই গুলিস্তানের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। 

অনেকে আবার ঘণ্টর পর ঘণ্টা খালি গাড়ি নিয়েই বসে আছেন, নিচ্ছেন বিশ্রাম। এতে করে দিনশেষে আর্থিক দৈন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। একই চিত্র দেখা যায় গুলিস্তান থেকে সদরঘাটে আসার ক্ষেত্রেও। ঘোড়ার গাড়িতে চড়া যাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবয়সী ও বয়স্ক। তরুণদের তেমন লক্ষ্য করা যায়নি।

আগে প্রতিদিন ৫-৬টি ট্রিপ দিতে পারলেও এখন যানজট ঠেলে ও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২-৩টি ট্রিপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ট্রিপ শেষে মালিকের জমার টাকা দিয়ে দৈনিক ২০০-৩০০ টাকা পাচ্ছেন বলে দাবি কোচোয়ান ও হেল্পারদের। যাতে করে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের। অনেক মালিক আবার কম মজুরিতে শিশুদের দিয়েই চালাচ্ছেন গাড়ি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সমাপনী অনুষ্ঠানে আগে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাস ও পুরান ঢাকা প্রদক্ষিণ করা হতো। এখন সেই দৃশ্য তেমনে চোখে পড়ে না।

ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান মমিন উদ্দীন বলেন, এখন যাত্রী পেতে লড়াই করতে হয়। আগে যাত্রী পাওয়া যেত পর্যাপ্ত। তাই সিরিয়াল অনুযায়ী গাড়ি চলতো। এখন কোনো সিরিয়াল নেই, যে যখন পারছে তখনই ছেড়ে যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে। দিনশেষে মালিকের জমার টাকা ঠিকই দিতে হয়। কিন্তু আমরা নামমাত্র মজুরি নিতে পারি। আগে ৫০০-৬০০ টাকা মজুরি নিতে পারতাম সব খরচ মিটিয়ে এখন ২০০-৩০০ টাকা পাই। আগে মানুষ পরিবার নিয়ে যাতায়াত করতো ঘোড়ার গাড়িতে। এখন সেই চিত্র দেখা যায় না আর।

এই কোচোয়ান বলেন, পুরান ঢাকার স্থানীয় লোকজনই এখন তুলনামূলক বেশি চড়েন ঘোড়ার গাড়িতে। এই  প্রতিটি গাড়িতে একজন চালকের সাথে একজন হেল্পার থাকে। এখন যেই পরিস্থিতি তাতে দুইজনেরই টানাপোড়েন যায়। আমার বাবাও এই পেশার সাথেই যুক্ত ছিলেন। উত্তরসূরী হিসেবে আমিও এটাতেই যুক্ত ৯ বছর ধরে।

ঘোড়ার গাড়িতে চড়া পুরান ঢাকার বাসিন্দা বেলাল হোসাইন বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখতাম ঘোড়ার গাড়িতেই মানুষজন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। এখন সময় পাল্টেছে। অন্যান্য যানবাহন আছে পর্যাপ্ত। দেখা যায় সময় বাঁচাতে মানুষ এখন অন্য যানবাহনেই চলে যায় গন্তব্যস্থলে। আমি মাঝে মধ্যেই ঘোড়ার গাড়িতে চলাচল করি। এটায় একটা ভালো লাগা কাজ করে।

বিভি/টিটি

মন্তব্য করুন: