২৬ ফেব্রুয়ারি রকিবুল হাসানের ব্যাটে ক্রীড়াঙ্গনে যুদ্ধের সূচনা

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি উত্তাল সারা বাংলাদেশ, যুদ্ধের দামামা বাজছে সবদিকেই। শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণাই বাকি। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের রাজপথই প্রতিদিনই মিছিল-মিটিংয়ে উত্তপ্ত। এরমধ্যেই ঢাকায় বেসরকারি টেস্ট খেলতে এসেছে আন্তর্জাতিক একাদশ। সেই দলে ইস্ট পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি তরুণ রকিবুল হাসান।
ম্যাচের আগের দিন পাকিস্তানের সব খেলোয়াড়কে দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ান উইলো ‘গ্রে-নিকোলস’ ব্যাট। সেই ব্যাটে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ার স্টিকার বসানো ছিলো। বাংলার একমাত্র ক্রিকেটার রকিবুল হাসানকে দেওয়া হয় ‘গান এন্ড মুর’ ব্যাট। এই ব্যাট হাতে পেয়ে রকিবুলের মাথায় ঘুরতে থাকে অন্য কিছু করার তাড়না।
দলে সুযোগ পাওয়ায় রাতে পূর্বাণী হোটেলে রকিবুল হাসানকে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। রকিবুল এই সুযোগে শেখ কামালকে জানান ব্যাটে বাংলাদেশের মুক্তির স্লোগান ‘জয় বাংলা’ স্টিকার লাগাবেন। যে কথা সেই কাজ, তখনই ছাত্রনেতা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠানো হয় এবং ‘জয় বাংলা’ স্টিকার আনিয়ে রকিবুলের ব্যাটে তা লাগিয়ে দেন শেখ কামাল।
এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রকিবুল বলেন, আসলে তখন আমরা ছাত্ররা সবাই রাজনীতি সচেতন ছিলাম। দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কিন্তু রাজনীতিবিদরাই বেশি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিপক্ষে সোচ্চার ছিলো। ক্রীড়াঙ্গনে এর প্রভাব কম ছিলো। তাই ভাবলাম এমন কিছু করি, যাতে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিপক্ষে জেগে ওঠে এবং বিদেশি ক্রিকেটার, সাংবাদিকরা যারা ম্যাচ কাভার করতে এসেছে, তারা যাতে জানতে পারে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য। সেই চিন্তাতেই ব্যাটে স্টিকার লাগানোর পরিকল্পনা।
পরের দিন সকালে সেই ব্যাট নিয়েই পাকিস্তানি ওপেনার আজমত রানাকে নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামেন রকিবুল। প্রথমে কেউ বুঝতে পারেননি ব্যাটে স্টিকার লাগানোর কথা। ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলতে গিয়ে বিষয়টি প্রকাশ হয় এবং পর্যায়ক্রমে বিষয়টি পুরো স্টেডিয়ামে ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাটি। গ্যালারিতে উপস্থিত প্রায় ১২ হাজার দর্শকের মধ্যেও এই স্পিরিট সংক্রমিত হয় এবং সবাই জয় বাংলা স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরের দিন দেশের সংবাদমাধ্যম সহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও ছাপা হয় এই জয় বাংলা স্টিকার লাগানো ব্যাট নিয়ে খেলতে নামার ছবি।
রকিবুল হাসান স্মৃতিচারণ করেন, ম্যাচের চতুর্থ দিন ছিলো মার্চের এক তারিখ। সেদিন সংসদে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন ছিলো। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর তো করেইনি, বরং পাকিস্তানীদের টালবাহানায় সারা পূর্ব বাংলা জ্বলে ওঠে। স্টেডিয়ামেও এর প্রতিবাদে শুরু হয় বিক্ষোভ। উত্তেজিত দর্শকরা স্টেডিয়ামের প্যান্ডেলে আগুন লাগিয়ে দেন, পন্ড হয় ম্যাচ। আমার প্রচেষ্টা সফল হয়, কারণ স্টেডিয়ামের দর্শকদের উত্তেজিত করতে এই জয় বাংলা স্টিকার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিলো।
রকিবুল আরো যোগ করেন, ম্যাচের প্রথম দিনেই পাকিস্তান দলের ম্যানেজার ও অধিনায়ক সাঈদ আহমেদ তার কাজে জানতে চান স্টিকারে কি কথা লেখা? কেন বাংলায় এই স্টিকার লাগানো হয়েছে সেই কৈফিয়তও তলব করেন ম্যানেজার। কিন্তু নানা কথা বলে তাদের দমিয়ে রাখেন রকিবুল। কিন্তু পত্রিকায় নিউজটি প্রচার হলে পাকিস্তান দলের সবাই জানতে পারেন স্টিকারে অর্থ। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বিষয়টি জেনে যায়। রকিবুলের কাছে এর ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়। তখন কঠিন বিপদে পড়েন রকিবুল। গোয়েন্দা বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিষয়টি তদন্তের। তবে তারা রকিবুলকে নজরদারীতে রাখলেও, ম্যাচ চলাকালীন বিরক্ত করেনি। গোয়েন্দা পুলিশ অপেক্ষায় ছিলো ম্যাচ শেষ হবার। তবে রকিবুল ভয় পেয়ে যান যখন পাকিস্তান আর্মি তাঁর পুরোনো ঢাকার বাড়িতে খোঁজখবর নিতে অভিযান চালায়। এই ঘটনার পরই তার পুরো পরিবার ঢাকা ছেড়ে গোপালগঞ্জে নিজেদের বাড়িতে চলে যায় এবং ম্যাচের চতুর্থ দিনে স্টেডিয়ামে গণ্ডগোলের সুযোগে রকিবুলও ম্যানেজারকে মুচলেকা দিয়ে টিম ছেড়ে চলে যান।
এই ঘটনার পর রকিবুলকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয়, ফলে পালিয়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। মার্চের শুরুতে তাঁর বিরুদ্ধে দেখা মাত্র গুলির নির্দেশও দেওয়া হয়েছিলো। জীবন বাঁচাতে ভারতে চলে যান রকিবুল।
সেদিনের কথা স্মরণ করে রকিবুল বলেন, এখনো সেই ঘটনা মনে করলে গর্বে বুক ফুলে ওঠে। স্টেডিয়ামে যে আন্দোলন হয়েছে তার মূলে ছিলো আমার ব্যাটের স্টিকার। এটা আমার ও আমার পরিবারের জন্য বড় ঘটনা এবং আমার ওই ঘটনার কারণেই বড় দুই ভাই যুদ্ধে যাবার প্রেরণা পেয়েছিলেন।
(রকিবুল হাসান পরবর্তীতে দেশের ক্রিকেট আইকন, জাতীয় অধিনায়ক, নির্বাচক, জাতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন এবং বর্তমানে আইসিসি ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করছেন।)
বিভি/এসডি
মন্তব্য করুন: