পদ্যের জন্যে ২০ টাকা আর গদ্যের জন্যে ২৫ টাকা
আমার ছড়াযাত্রা শুরু হয়েছিলো দাদাভাইয়ের হাত ধরে ১৯৭২ সালে, ইত্তেফাকের ছোটদের পাতা কচি-কাঁচার আসরের মাধ্যমে। এরপর আমার কতো যে লেখা আর আঁকা ছবি ছাপা হয়েছে কচি-কাঁচার আসরে তার হিশেব নেই। এক পর্যায়ে লেখাটাকেই আরাধ্য বিবেচনা করে আঁকাটাকে ছেড়ে দিলাম। আমার প্রচুর লেখা ছেপেছেন দাদাভাই(রোকনুজ্জামান খান)। অনেকদিন লেখার পর একটু যখন নাম-ডাক হলো, দাদাভাই প্রতিটা লেখার জন্যে আমাকে সম্মানী দিতে শুরু করলেন। একদিন নিজেই জানালেন তিনি ঘটনাটা। বললেন—একাউন্টস সেকশনে গিয়ে লেখক-সম্মানীর টাকা নিয়ে এসো। আমি বিল করেছি গত পরশু। বুঝলাম—লেখক হিশেবে আমার পদোন্নতি হয়েছে। দাদাভাই তাঁর পাতায় প্রকাশিত সব লেখার বিল করেন না। নিজেকে বেশ মর্যাদাবান একজন লেখক হিশেবে ভাবার একটা সুযোগ এলো।
তখন, রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ইত্তেফাক অফিসের দোতলায় বসতেন দাদাভাই। ইত্তেফাকের একাউন্টস সেকশন তিনতলায়। লেখার বিল তুলতে গিয়ে পরিচয় হলো অবিরাম পান খাওয়া গাঙ্গুলি বাবুর সঙ্গে। হাসিখুশি মোটাসোটা মানুষ। আমি তরুণ একজন লেখক। তরুণ লেখক মানেই আধা লেখক। কিন্তু আমাকে তিনি সম্মান দেখালেন পুরো লেখকের। তাঁর কাছে বিলের কপি ছিলো। আমার কয়েকটা লেখার বিল একসঙ্গে যোগ করে তিনি একটা রিসিটে সব টাকা একসঙ্গে দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন। পদ্যের জন্যে ২০ টাকা আর গদ্যের জন্যে ২৫ টাকা। সব মিলিয়ে দেড়শ টাকার মতো পেলাম।
ইত্তেফাকের উল্টোদিকে ছোট্ট একটা রেস্তোরাঁ ছিলো—দেশবন্ধু। দেশবন্ধুর পরোটা-ভাজির স্বাদটা দুর্ধর্ষ রকমের ভালো। ভাজিতে নানান রকমের সবজি থাকতো। মিষ্টি কুমড়ো, বাঁধা কপি, গাজর, আলু ইত্যাদির সঙ্গে পাঁচ ফোড়নের অবাক মিশ্রণে স্বর্গীয় একটা জিনিস তৈরি হতো ভাজির আদলে। মনে আছে প্রথম পাওয়া বিল-এর সেই টাকায় কয়েকজন লেখক বন্ধুকে নিয়ে বিস্তর পরোটা আর ভাজি সাঁটিয়েছিলাম!
দেশবন্ধুর পরোটা-ভাজি আমার খুব প্রিয় ছিলো। ওদের রসগোল্লাটাও ছিলো দুর্দান্ত। তবে দেশবন্ধুতে দুপুরে কখনো ভাত খেলে ওদের মুড়িঘন্টটা অর্ডার করা ছিলো মাস্ট। ঢাকার আর কোনো রেস্তোরাঁয় এরকম সুস্বাদু মুড়িঘন্ট পাওয়া যেতো না।
দাদাভাই লেখার বিল করতেন দুতিন মাস পরপর। কিন্তু আমি একাউন্টস সেকশনে সেই টাকা তুলতে যেতাম বছরে দুবার। তাতে টাকার অঙ্কটা খানিক স্বাস্থ্যবান হতো। এভাবেই চলছিলো বছরের পর বছর। আমার নাম-যশ-খ্যাতি বৃদ্ধি পাচ্ছিলো কিন্তু সম্মানীর অঙ্কটা বাড়ছিলো না তেমন। ছড়ার জন্যে ২০/২৫ টাকা আর গদ্যের জন্যে ৩০/৩৫ টাকা বরাদ্দ করতেন দাদাভাই। বিটিভির কল্যাণে আমার চেহারাটা মোটামুটি একটা পরিচিত পরিচিত ধরণের পর্যায়ে তখন। একাউন্টস সেকশনে গেলে গাঙ্গুলি বাবু আগের মতোই সম্মান দেখান আমাকে। বাড়তি সম্মান হিশেবে মাঝে মধ্যেই এক কাপ চা খাওয়ান। একদিন বিলের টাকা ২০+২৫+২০+৩০+২৫ এরকম যোগ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। বরিশাইল্লা এক্সেন্টে গাঙ্গুলি বাবু বললেন—আপনারা দাদাভাইকে কিছু বলেন না কেনো? একটা লেখার জন্যে এইরকম কুড়ি টাকা তিরিশ টাকার বিল দাদাভাই করেন কীভাবে!
আমি মিটিমিটি হাসি। কারণ এই লোক জানেন না—আমি দাদাভাইকে জীবনেও সম্মানী হিশেবে আমাকে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিতে বলতে পারবো না। গাঙ্গুলি বাবু বললেন—শোনেন ভাই, ইত্তেফাক কোনো গরিব প্রতিষ্ঠান না। লেখক কবিদের সম্মানীর টাকা বাড়িয়ে দিলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের মালিক মইনুল সাহেব আর মঞ্জু সাহেবের কিছুই আসবে যাবে না। মালিকদের টাকা তাতে কমেও যাবে না। আমি নিশ্চিত দাদাভাই যদি লেখকদের টাকার বরাদ্দ বাড়িয়ে দেন তো মালিকদের একজনও আপত্তি করবেন না। আপনারা দাদাভাইকে ধরেন। টাকাটা তো আর তিনি দিচ্ছেন না। এটা ইত্তেফাকের টাকা। দাদাভাইয়ের অসুবিধা কী?
এরপরও আমি মিটিমিটি হাসি। রাজি হই না দাদাভাইকে ধরার বিষয়ে। আমাকে উদ্বুদ্ধ করণে ব্যর্থ হয়ে গাঙ্গুলি বাবু পানভর্তি মুখে আরেকটু চূন ঠেঁসে দিয়ে বললেন—শোনেন ভাই যেই আমি গাঙ্গুলি এই হাতে দাদাভাইকে মাসে মাসে ছয় হাজার টাকা তুলে দিয়েছি বেতন বাবদ, সেই আমিই তাঁর হাতে মাসে মাসে ষাট হাজার তুলে দিচ্ছি। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তাঁর বেতনও বেড়েছে। কিন্তু আপনাদের বিল সেই কুড়ি টাকা আর তিরিশ টাকাই রয়ে গেছে! ভেরি স্যাড! গাঙ্গুলি বাবুর এইরকম মারাত্মক ভাষণের পরেও আমি মিটিমিটি হাসি। গাঙ্গুলি বাবু চরম হতাশা ব্যাক্ত করেন—ধুর ভাই আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। একটু সাহসী হন। দাদাভাইকে ধরেন। আপনাকে পঁচিশ তিরিশ টাকা দিতে আমাদেরও তো লজ্জা লাগে রে ভাই!
গাঙ্গুলি বাবুর কথাগুলো সত্যি। কিন্তু আমি দাদাভাইকে কোনোদিনও বলতে পারবো না টাকা বাড়ানোর কথা। এই দাদাভাইয়ের হাত ধরেই তো আমার ছড়াযাত্রা শুরু হয়েছিলো। দাদাভাই যদি আমাকে পঁচিশ তিরিশ টাকা দিয়ে খুশি থাকেন তো আমিও তাতেই খুশি। সম্মানীর সামান্য কটা টাকার জন্যে দাদাভাইকে অসম্মান করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
তবে গাঙ্গুলি বাবুর কথাগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিলো। ঠিকই তো। ইত্তেফাক যদি লেখকদের টাকা বাড়াতে অসম্মত না থাকে তো দাদাভাইর সমস্যা কোথায়? দাদাভাইয়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় একদিন কায়দা বুঝে খুব সরল একটা প্রশ্ন করেছিলাম—আচ্ছ দাদাভাই, এই যে আপনি ছড়ার জন্যে বিল করেন ধরুন পঁচিশ টাকা কিন্তু সেই একই লেখককে গদ্যের জন্যে তিরিশ বা পঁয়ত্রিশ টাকা বিল করেন কেনো? লেখক তো একই।
দাদাভাই আমাকে বোঝালেন—একটা ছড়ায় শব্দ সংখ্যা থাকে খুব অল্প। কিন্তু একটা গল্পে বা প্রবন্ধে শব্দের সংখ্যা থাকে অনেক বেশি। তাই প্রোস আর পোয়েট্রির বিল দু’রকমের করতে হয়। আমি আর কথা বাড়ালাম না। যা বোঝার বুঝে গেলাম। দাদাভাইয়ের সাইকোলজিটা আমার কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেলো। একেবারে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। শব্দসংখ্যার ব্যাপারটা দাদাভাইয়ের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কারণ দাদাভাই দীর্ঘদিন দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ইত্তেফাক প্রতিনিধিরা খবর বা সংবাদ পাঠাতেন। প্রচুর কাটছাঁটের পর সেই সংবাদ ছাপা হতো। প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সেই প্রতিনিধিদের মাসিক বিল করতেন দাদাভাই। মফস্বল সাংবাদিকদের জন্যে ইত্তেফাকের বিলিং সিস্টেমটা ছিলো অদ্ভুত। মুদ্রিত খবরটির শব্দ কিংবা লাইন গুণেগুণে প্রতি শব্দে চার আনা কিংবা প্রতি লাইনে একটাকা ধরণের একটা হিশেবে বিলটা করা হতো। খবর দশ লাইনের হলে বিল দশ টাকা। পঞ্চাশ লাইনের হলে পঞ্চাশ টাকা। মফস্বল সাংবাদিকরা বেশি টাকার আকাঙ্খা থেকে কোনো খবরকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে বিস্তারিত পাঠালেও ইত্তেফাকের টেবিলে এসে সেই খবরটা চ্যাম্পিয়ন কোনো এডিটরের হাতে পড়ে ক্ষুদ্র আকারই ধারণ করতো শেষমেশ। এবং সেই সাংবাদিক বিল পেতেন অদ্ভুত সেই শব্দ কিংবা লাইন হিশেবে।
দীর্ঘকালব্যাপি মফস্বল বিভাগে জেলা প্রতিনিধিদের বিল করতে করতে দাদাভাইয়ের মস্তিষ্ক একটি লেখাকে শব্দ কিংবা লাইন হিশেবে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। যার প্রভাব ছড়া এবং গল্প-প্রবন্ধেও পড়েছিলো হয়তো বা। কারণ আমার ছোট আকারের একটি ছড়ার বিল দাদাভাই কুড়ি টাকা দিলেও বড় আকারের একটি ছড়ার জন্যে দিতেন পাঁচ বা দশ টাকা বেশি।
এরপর সময় গড়ালো।
অনেকদিন ইত্তেফাকের একাউন্টস সেকশনে যাইনি। এক দুপুরে গেলাম। দেখলাম, গাঙ্গুলি বাবু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতে একটা বড়সড় অপারেশন করিয়ে এসেছেন। আগের মতো আমুদে ভাবটা নেই। নেই সেই ছটফটানিটাও। তবে আমার বিলের নমুনা সেই আগের অবস্থানে দেখে আগের মতোই হতাশা ব্যাক্ত করলেন—নাহ্ নিজের মর্যাদা নিজেরাই রক্ষা করতে চান না আপনারা। ‘আম্নারে দিয়া অইবে না।’
সেবার ইত্তেফাকের বিল তুলতে গিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটিয়েছিলাম। আগে, গাঙ্গুলি বাবুর সই করা ভাউচারে তাঁর পাশের আরেক ভদ্রলোক সই করলেই চারতলার ক্যাশ সেকশনে গিয়ে টাকাটা তুলে আনা যেতো। এবার গাঙ্গুলি বাবু অদূরেই একটা ছোট্ট কাচঘেরা কক্ষ দেখিয়ে বললেন—কাইন্ডলি ওনার কাছ থেকে সই করিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গাঙ্গুলি বাবুকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলাম সেই ভদ্রলোকের কক্ষের সামনে। ছিমছাম ছোটখাটো গড়নের একজন মানুষ। পরিপাটি ইস্ত্রি করা প্যান্টে ইন করা শার্ট। গলায় কলার প্যাঁচানো ঢিলেঢালা ভঙ্গিতে একটা নিরিহ টাই ঝুলছে। সালাম দিয়ে রুমে ঢুকতে চাইলে ইশারায় তিনি থামিয়ে দিলেন। আমার হাতে ভাউচার দেখেই বুঝেছেন আমি তাঁর সাক্ষর প্রার্থী। বললেন—এখন হবে না। পরে আসেন। আমি এখন লাঞ্চ করবো। বলেই আমার সামনে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন টয়লেট বা প্রক্ষালন কক্ষের দিকে। ওখান থেকে হাত মুখ ধুয়ে রুমালে কপাল মুছতে মুছতে খুব মন্থর গতিতে তিনি রুমে এসে নিজের আসনে বসলেন। চেয়ারের পাশ থেকে ছোট্ট চারতলা একটা টিফিনবক্স টাইপের হটপট বের করলেন। চারটে ছোট্ট ছোট্ট বাটি। একটায় ভাত। একটায় খুব অল্প পরিমানে কিছু সেদ্ধ সবজি। ওখানে ফুলকপি, বরবটি, গাজর আর শীমের দেখা মিললো। একটায় দু’টুকরো মুরগির মাংস, তেলহীন, ঝালহীন ফ্যাকাসে মেডিক্যাল রঙের, সঙ্গে দু’পিস আলু। অন্যটায় হালকা হলদেটে মশুরের ডাল। আমি তখনো দরোজার ওপাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে তিনি চেয়ারটা খানিক ঘুরিয়ে তাঁর খানাখাদ্যকে আড়াল করলেন। আমার ভেতরে তখন অভিনয় প্রতিভা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। আমি ক্ষুধার্ত বুভুক্ষ একজন মানুষের মতো বিপুল উদ্যমে প্রবল উৎসাহে তাঁর ফকফকা মেডিক্যাল খাবারের দিকে নজর রাখতে বদ্ধপরিকর হলাম। চান্স পেলেই উঁকি মারছি। ব্যাপারটা তিনি অপছন্দ করলেন। নিজের প্লেট এবং বাটিগুলো আরো ডানদিকে ঠেলে দিয়ে রিভলবিং চেয়ারটা আরো ডানদিকে ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। এইবার তাঁর খাবারের দিকে নজর দেয়ার আর কোনো সুযোগই থাকলো না। কারণ পুরো চেয়ার এবং নিজের শরীর দিয়ে তিনি খাবার আড়াল করে নিয়েছেন!
লক্ষ্য করলাম, তিনি খাচ্ছেন খুব আয়েসী স্লো মোশনে। অনেকক্ষণ ধরে খাচ্ছেন। এক পর্যায়ে পায়ে পায়ে কাঁচঘেরা সেই কক্ষটির অপর প্রান্তে চলে গেলাম আমি। খাওয়ার ব্যাপারে মহা মনোযোগী লোকটা কিছুক্ষণ আমাকে খেয়ালই করলেন না। একটু পরে মাথা তুলেই সামনে কাচের ওপাশে আমাকে পুনরায় আবিস্কার করে বিরক্তিতে একেবারে মুষড়ে পড়লেন ভদ্রলোক। একটা নিঃশব্দ আর্তনাদ যেনো বা শুনতে পেলাম আমি। পৃথিবীর কোনো ব্যাপারেই আমার যেনো কোনো আগ্রহ নেই, এমন আগ্রাসী এবং মুগ্ধ চোখে আমি শুধু তাঁর খাওয়ার আইটেমগুলোকে দেখছি।
দ্রুত বাটিগুলো গুটিয়ে ফেললেন তিনি। তারপর বিরক্তিতে চুড়চুড় হওয়া একটা চেহারা নিয়ে হাত ধুতে গেলেন ফের সেই প্রক্ষালন কক্ষে। খানিক বাদে ফিরে এসে চেয়ারের পিঠে ঝুলতে থাকা টাওয়ালে হাত মুছলেন। অতঃপর আমাকে ইশারা করলেন ভেতরে প্রবেশের। আমি আড়াইশ টাকার ভাউচারটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কণ্ঠে বিপুল উচ্ছ্বাস মেখে জিজ্ঞেস করলাম—বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসেন, না? মুর্গিটা মনে হয় খুব টেস্টি ছিলো!
আমার কথায় কান না দিয়ে ভাউচারে সই দিতে দিতে ভদ্রলোক খুব গম্ভীর ভাব নিয়ে বললেন—সামান্য এই ক’টা টাকার জন্যে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন! আর বারবার আমার খাবারের দিকে ওরকম নজর দিচ্ছিলেন কেনো?
আমি বললাম—এটাকে সামান্য বলছেন স্যার? আড়াইশ টাকা স্যার মোটেও সামান্য নয়। আমার ছয়মাসের লেখার বিল এটা!
আমাকে ভাউচারটা ফেরত দিয়ে তিনি জানতে চাইলেন—এই টাকা দিয়ে এখন কী করবেন?আমি বললাম—খাবো স্যার। দেশবন্ধুর পরোটা-ভাজি! আহা কতোদিন খাই না! (এমনভাবে বললাম যে এই টাকা না পেলে আজ আমাকে উপোস দিতে হতো।) আমার কথায় কাজ হলো। গভীর আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোক একজন দুস্থ লেখককে অবলোকন করছেন। কিন্তু, আমার ক্ষুধার্ত মলিন চেহারার সঙ্গে আমার গাঢ় নীল জিন্সের প্যান্ট, কালো বেল্ট, হাতাগোটানো ফুলস্লিভ বর্ণিল স্ট্রাইপ শার্ট আর জুতো জোড়াকে দারিদ্র্যের সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে না পেরে মহাবিভ্রান্তিতে পড়ে গেলেন তিনি। (লোকটাকে বিভ্রান্তির ফাঁপড়ে রেখে লম্বা একটা সালাম কষে আমি যখন বিদায় নিচ্ছি—তখন আমার মানিব্যাগে টেলিভিশন থেকে পাওয়া তিনহাজার টাকার কড়কড়ে নোট!)
একাউন্টস সেকশনের সেই কচ্ছপ-মানবকে বিভ্রান্ত করার আনন্দটা পেতে ঘন্টাখানেকের একটা ধৈর্যের পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ হতে হয়েছিলো সেদিন। আমার ভাউচারে একটা সই দিতে তাঁর ত্রিশ সেকেন্ডও লাগেনি। কিন্তু ত্রিশ সেকেন্ডের সেই সইটা দিতে তিনি সময় নিয়েছিলেন পুরো একটি ঘন্টা! আমি জানতাম লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকদের দুস্থ ভাবতে এবং দুস্থ দেখতে পছন্দ করে আমাদের সমাজ ও সমাজের মানুষগুলো। আর দুস্থদের কোনো সম্মান থাকে না। আমি সেদিন একাউন্টসের একজন বড়কর্তা কর্তৃক একজন লেখককে তুচ্ছ জ্ঞান করার গড়পরতা মানসিকতাটাকে আরেকবার প্রত্যক্ষ্য করেছিলাম।
তারপর সময় গড়িয়েছে। দেশ এগিয়েছে। আমিও এগিয়েছি। আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এখন একশ-রও বেশি। কিন্তু আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকদের দুস্থ ভাবতে এখনও পছন্দ করে আমাদের সমাজ ও সমাজের মানুষগুলো।
মন্তব্য করুন: