জুলাই আন্দোলন: মামলা বাণিজ্য
এক ব্যক্তি মারা যায় তিন বার, কারাগারে বসেই করেন হত্যা!
এক ব্যক্তি মারা যায় তিন বার। মামলা হয় তিনটি আলাদা আলদা স্থান ও থানা। আবার কেউ কারাগারে বসেই সরাসরি জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে করেন ছাত্র হত্যা। আবার কেউ জীবনে যে জেলায় জাননি তবুও তিনি সেই জেলায় চালিয়েছেন নাশকতা, ভাংচুর। হয়েছেন সেই মামলার আসামিও। বাংলাভিশনের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে এমন সব মামলার রহস্য। যার প্রতিটি মামলার পেছনে রয়েছে বাণিজ্য। সম্প্রতি বাংলাভিশনের অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ‘ ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন’
বেড়িয়ে আসে কারাগারে বসে হত্যা, তিন হত্যার রহস্যসহ মামলাবাজ সিণ্ডিকেটের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মো.আল আমিন। গত বছরের জুলাই আন্দোলনে ৫ আগষ্ট বাড্ডা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিনি। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ৩-৪ মাস পর। হঠাৎ নিহত আলামিনের বাড়িতে অপরিচিত মানুষ ও সাংবাদিক আসতে শুরু করলে। তখন তারা জানতে পারেন তার ভাই হত্যার ঘটনায় ভাটারা ও হাতিরঝিল থানায় দু’টি হত্যা মামলা হয়েছে। তবে বাদিদের কাওকে চেনেন না আলামিনের পরিবার। তাহলে তারা মামলা করলেন কীভাবে?
বাংলাভিশনের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। মামলার নথিতে দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী নিহত আলামিনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সাথে।
নিহত আলামিনের স্ত্রী সুমি আক্তার বাংলাভিশনকে বলেন, ‘ আমার স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর জানতে পারি। কারা জানি দুইটি হত্যা মামলা করেছে। পরে খোঁজ খবর নিয়ে দেখি এক নেতা আর মোজারুল নামের এক ব্যক্তি। যিনি ভূয়া বাদি। অন্য মেয়েকে নিয়ে আলামিনের স্ত্রী সুমি বানিয়ে মৃত্যু সনদ তুলে প্রতারণা করে মামলা করেছে। যার কিছুই আমরা জানিনা। আজও সেই কাগজ আমাদের দেয়নি প্রতারক চক্রটি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আলামিন বাড্ডা এলাকায় মারা গেলেও সেই থানায় কোন মামলা হয়নি বছর পেরুলেও। আলাদা আলাদা স্থান দেখিয়ে হাতিরঝিল ও ভাটারা থানায় দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। অর্থাৎ শুরুতেই তাকে দুই বার মেরে ফেলা হল।মামলার বাদিও আলাদা আলাদা। যারা আলামিনের পরিবারের কেউ নয়।
আলামিনের স্ত্রী ও বড় ভাইয়ের কথার সূত্রধরে এবার মামলার বাদিদের সন্ধানে গেলে পাওয়া যায়নি ভাটারা থানার মামলার বাদিকে। তবে হাতিরঝিল থানার বাদী মোজারুলের সন্ধান প্রথমে পাওয়া না গেলেও পরে তার দেখা মিলে। আমাদের কাছে তথ্য আসে এই মুহুর্তে মহানগর প্রজেক্টের একটি বাসায় অবস্থান করছে মোজারুল।
কেন তিনি ভূয়া মামলা করলেন এই বিষয়ে জানতে চাইলে মোজারুল বাংলাভিশনকে বলেন, ‘আমি মামলা করতে চাইনি আমাকে কয়েকজন নেতা জোড় করে মামলা কইরাছে।’
নিহত পরিবারের মৃত্যু সনদসহ অন্যান্য কাগজপত্র কেন ফেরত দেয়া হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এসবের কিছুই আমার কাছে নেই। সব ওই নেতার কাছে। বলে দায় সেরে চলে যান।’
নিহত আলামিনের বড় ভাই মামলার বাদি পারভেজ বাংলাভিশনকে বলেন, ‘যারা মৃত্যু সনদ ও কাগজ নিয়ে প্রতারণা করেছে সেই চক্রের সদস্যকে আসামি করেছি। এই দুই ভূয়া মামলা নিয়ে বিপাকে যেমন আমরা ঠিক তেমনই সমস্যায় পরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। মামলা জটিলতা থেকে বের হতে পুলিশের পরামর্শে আমি হত্যার সঠিক ঘটনাস্থল বাড্ডা থানায় মামলা করি। তাও ভাই মারা যাওয়ার ১ বছর পর। এখন মামলা পিবিআই দেখছেন। যারা জড়িত তারা ধরা পড়বেন যারা জড়িত না তারা যেন মুক্তি পান আমি এটাই চাই।’
কারাগারে থেকেও হত্যা মামলার আসামি হলেন যেভাবে
আবুল কালাম আজাদ। গতবছর জুলাই আন্দোলন যখন তঙ্গে তখন পুলিশের ওপর হামলা, পিকেটিং, বিএনপি-জামায়াতের অর্থদাতার ট্যাগ লাগিয়ে তুরাগ থানাধীন বাউনিয়া বাদালদি এলাকার নিজ বাসার সামনে থেকে ২৩ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করে তুরাগ থানা পুলিশ। এর পর তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন ৭ আগষ্টের পর।
এরপর একদিন জানতে পারেন তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতার ট্যাগ লাগিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। অর্থাৎ কারাগারে গেলেন জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকার কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতা হিসেবে। আর কারাগারে থেকে হলেন আওয়ামী লীগ নেতা। এভাবে তার বিরুদ্ধে দুইটি হত্যা মামলা হয়।
দুই মামলার বাদিদের একজন আলেয়া বেগম জানান,‘আমার ছেলে আলমগীর মারা গেছে। সেই ঘটনায় মামলা করেছি তবে, অনেক আসামিকে তিনি চিনেন না। কারা এসব মানুষকে আসামি বানিয়েছে তার কিছুই জানেন না তিনি।
আরেক মামলার আসামি সাইফুল ইসলাম। তার মামলায় দেয়া বাড্ডা এলাকায় ঠিকানায় গেলে তাকে পাওয়া যায়নি।
বাসার কেয়ারটেকার ও এলাকাবাসীরা বলেন, ‘এই নামের কোন মানুষ এই বাসায় ছিলনা। আর জুলাই আন্দোলনেও কেউ এই বাসায় বা এই রোডে মারাও যায়নি। তারা বলছেন, পুলিশও এসে পায়নি কাওকে। মিথ্যা ঠিকানায় ভূয়া মামলা করেছেন বলে তারা দাবি করেন।’
মো. আবুল কালাম আজাদ বাংলাভিশনকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলাম। কারও সাথে আমার শত্রুতা ও ছিলনা। হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ আমলে আমার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েকটি গায়েবি মামলা হয়। পরে জানতে পারি এসব মামলার পেছনে আমার বাসায় মাহফুজ নামের এক ফ্ল্যাট মালিক থাকে তিনি এসব করান।
তিনি বলেন,‘বেশি অবাক হই, জুলাই আন্দোলনে আমাকে বিএনপি- জামায়াত ট্যাগ দিয়ে ২৩ জুলাই আমাকে বাসার সামনে থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে মামলায় ঢুকে দেয়। কিন্তু সেই আমিই আবার কারাগারে থেকে বেরিয়ে শুনি আমি নাকি ৫ আগষ্ট ছাত্র হত্যা করেছি। তাও আবার দুই মামলা। এর পেছনেও সেই মাহফুজের হাত রয়েছে। যার তথ্য প্রমান রয়েছে।’
জীবনে কোনদিন নেত্রকোনা না গিয়েও যেভাবে আসামি হলেন
জানে আলম। ৩০ বছরে জীবনে কোনদিন নেত্রকোনা যাননি। তবুও তিনি অথচ নেত্রকোণা মডেল থানায় করা নাশকতা, হামলা, ভাংচুরের ঘটনায় করা একটি মামলায় আসামি তিনি। মামলায় উল্লেখ করা সময়ে তিনি ছিলেন ঢাকায় তার নিজ কর্মস্থলে। যে মামলার আসামি নেত্রকোনায় থাকার পরে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না অথচ ভুয়া আসামিকে ধরতে নেত্রকোনা থেকে পুলিশের বিশেষ টিম পাঠিয়ে গভীর রাতে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে তুলে নিয়ে যান জানে আলমকে। কি মামলায় তাকে নেয়া হচ্ছে তার কিছুই জানো হয়নি তার পরিবারকে।
মামলার বিষয়ে জানে আলম বাংলাভিশনকে বলেন,‘আমি জীবনে নেত্রকোনায় যায়নি। তাহলে কীভাবে নাশকতা করলাম। আর যে তারিখ মামলায় দেখানো হয়েছে সেদিন আমি ঢাকায় আমার অফিসেই ছিলাম। তবুও আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে আমার সম্মান ক্ষুন্ন করার জন্যই কেউ এমন করেছে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আলমগীর মুনসুর বাংলাভিশনকে বলেন, ‘উনার বিষয়টা আমাদের নলেজে আছেন। মামলার ফাইনাল চার্জশিট থেকে উনার নাম বাদ দেয়া হয়ে বলে আশা করি। অন্যায় না করে কেউ হয়রানী হোক এটা আমরাও চাই না।’
এসব মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
জুলাই হত্যা মামলায় নিরপরাধ অনেকেই আসামি হওয়া ও এসব মামলা বাণিজ্যের পেছনে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপির) মুখপাত্র, মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলাভিশনকে বলেন,‘যখন এসব মামলা হয়েছে তখন পুলিশ গুছিয়ে উঠতে পেরেছিলনা। তবে এখন এসব মামলা যাচাই করা হচ্ছে। নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানীর শিকার না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। আর যারা এসব বাণিজ্যের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে প্রমান মিললে।’
জুলাই মামলায় যারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন তাদের রক্ষা পাওয়ার কোন পথ আছে কীনা?
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল উজ্জ্বল হোসেন বাংলাভিশনকে বলেন, ‘ এসব মামলায় অন্যায় ভাবে যেন কেউ হয়রানীর শিকার না হয় সেই দিক বিবেচনা করে নতুন আইন পাশ করা হয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে যারা জড়িত না তারা এসব মামলা থেকে রক্ষা পেয়ে যাবেন। আর যারা বাণিজ্যের সাথে জড়িত প্রমান পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইন রয়েছে।’
বিভি/ইএ/এজেড




মন্তব্য করুন: