• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-৪

সেন্টমার্টিনঃ ইসিএ আইনও লঙ্ঘন হয়েছে সরকারি টাকায়(ভিডিও)

কেফায়েত শাকিল

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ২০ জানুয়ারি ২০২২

আপডেট: ১৭:৪৪, ২০ মার্চ ২০২২

ফন্ট সাইজ

বছর দুয়েক আগে যারা সেন্টমার্টিনে গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই সৈকতে হেঁটেই ঘুরেছেন পুরো দ্বীপ। কেউ সাইকেল নিয়েও সৈকতের এমাথা-ওমাথা চক্কর দিয়েছেন। কারণ নিরবচ্ছিন্ন ছিলো দ্বীপের সৈকত। এখন আর তা সম্ভব নয়। কেননা, এখন এই দ্বীপে নিরবচ্ছিন্ন সৈকত বলে কিছু নেই। দ্বীপের পশ্চিমাংশের সৈকতে স্থান পেয়েছে বড় বড় অসংখ্য জিওব্যাগ। সৈকত আগলে নির্মিত দু‘টি রিসোর্ট রক্ষা করতেই ব্যবহৃত হয়েছে এই জিওব্যাগ। যার মধ্যে একটির মালিক বাংলাদেশ পুলিশ, অন্যটি ব্যক্তি মালিকানাধীন।

বাংলাদেশের একমাত্র জীববৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিবেশগত এই প্রবাল দ্বীপকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা বা ইসিএ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। দ্বীপের ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন হলে প্রতিবেশব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি দ্বীপ বিলীনের শঙ্কা থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই একান্ত প্রয়োজনে এখানে কোনো উন্নয়ন করতে হলে পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। কিন্তু আতঙ্কের বিষয় হলো, নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই এই দ্বীপে নির্মিত হয়েছে দুই শতাধিক স্থাপনা। যার মধ্যে অসংখ্য সরকারি স্থাপনাও রয়েছে। সামালোচনার বিষয় হলো, যেই পরিবেশ অধিদফতরের দায়িত্ব ছিলো ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ সেই অধিদফতর নিজেই গড়েছে ৪টি ভবনের একটি রিসোর্ট। 

দ্বীপের গলাচিপা অংশে গড়ে তোলা পরিবেশ অধিদফতরের রিসোর্টের নাম দেওয়া হয়েছে মেরিন পার্ক। পার্কটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ৩টি দ্বিতল ও একটি একতলা ভবন রয়েছে এই পার্কে। সেন্টমার্টিনে সংস্থাটির স্থায়ী কোনো জনবল না থাকলেও এই পার্কে  রাখা হয়েছে বিশাল অডিটোরিয়াম, রেস্ট হাউস, গবেষণার জন্য ভবন। 

দ্বীপে পরিবেশ অধিদফতরের জনবল বলতে শুধু আব্দুল আজিজ নামে এক কর্মচারি রয়েছেন। সুবিশাল অডিটোরিয়ামটিতে কখনো কোনো প্রোগ্রাম হয়েছিলো কি না জানতে চাইলে আজিজ বলেন, একবার মন্ত্রী এসেছিলেন, সেদিন এখানে প্রোগ্রাম হয়েছে। এছাড়া তেমন কোনো প্রোগ্রামের নজির নেই। 

রিসোর্টে কারা থাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে প্রায়ই গেস্ট আসেন। আমাদের স্যাররাও আসেন। পুরোপুরি খালি থাকে এমন সময় খুব কমই যায়। 

মেরিন পার্ক সংরক্ষিত হওয়ায় খুব একটা দেখার সুযোগ হয় না সাধারণ পর্যটকদের। তাই  সৈকত আগলে পুলিশের করা রিসোর্ট দেখে অনেকে কষ্ট পেলেও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের এই ভবনবিলাস কারো দেখাও হয় না। কেউ বিশদ জানেনও না এ সম্পর্কে। 

শুধু কি পরিবেশ আর পুলিশই ভবন করেছে?
না, বাদ যায়নি কেউই। পর্যটন করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড সবাই ভবন গড়েছে সঙ্কটাপন্ন এই দ্বীপে। সমুদ্রের মাঝে জেগে ওঠা এই দ্বীপে ভবন তোলার তালিকায় আগে বাদ পড়লেও এখন উঠে পড়ে লেগেছে এমন সরকারি সংস্থাও আছে কয়েকটি। বহুতল ভবনের কাজ শুরু করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ও।  সরকারি ভবনের যখন ছড়াছড়ি তখন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঠেকায় কে? এই সুযোগেই একে একে গড়ে উঠছে অসংখ্য হোটেল-রিসোর্ট।  

ইসিএ ঘোষণার পর প্রতিবেশ সংরক্ষণের নামে পরপর ৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনে টাকা ঢেলেছে পরিবেশ অধিদফতর। কিন্তু স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন ঘোষণার পরই সবচেয়ে বেশি প্রতিবেশ হারিয়েছে এই দ্বীপ। নিষিদ্ধ দ্বীপে চলেছে ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা। তাঁদের মতে, সবচেয়ে বেশি ভবন উঠেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। যার প্রমাণ মেলে গুগল ম্যাপ যাচাইয়েও। সবশেষ প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ নামের একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে গত জুনে। এই প্রকল্প চলাকালেও প্রতিনিয়ত এসেছে নির্মাণসামগ্রী। উঠেছে হোটেল-রির্সোট ভবন। সরজমিন গিয়েও নতুন নতুন ভবন তুলতে দেখা গেছে। নিষিদ্ধ হলেও প্রকাশ্যেই  এখানে এসেছে, আসছে ইট, বালু, সিমেন্ট। এর সংগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ করেন অনেকে। এসব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জোর আপত্তি জানিয়ে আসছেন স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবাদীরা। 

ষাটোর্ধ্ব আব্দুল আলিম বেড়ে উঠেছেন সেন্টমার্টিনের মাটিতে। দেখেছেন এখানকার পরিবর্তন। তাঁর মনে চরম ক্ষোভ পরিবেশ অধিদফতরের ওপর। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, জন্ম থেকে ঝড়ঝঞ্জা সহ্য করে আসছি আমরা। আমাদের বাড়িটা শক্ত করে বানাতে পারলে একটু নিরাপদ হইতো। কিন্তু পরিবেশের যন্ত্রণায় পরি না। অথচ নিজেরা ঠিকই বিল্ডিংয়ের ওপর বিল্ডিং তুলেছে।

গত ৭ থেকে ১০ বছরে সেন্টমার্টিনে সবচেয়ে বেশি ভবন উঠেছে বলে জানিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, এখানে বেশি টাকা থাকলে সব করা যায়। কিন্তু আমাদের তো এতো টাকা নাই। এজন্য আমরা বাড়িও বানাইতে অনুমতি পাই না।

যুবক রাসেল সরকার বলেন, পরিবেশ অধিদফতর খালি স্থানীয়দের ঠেকায়। অথচ কতোগুলো সরকারি সংস্থা বিল্ডিং তুলেছে। ঢাকার লোকজন এসে হোটেল বানাইছে। আমরা করতে চাইলে ভেঙে দেয়, নয়তো মামলা দেয়।

আরেকজন বলেন, পরিবেশ অধিদফতর একদিকে না বলে আরেকদিকে হ্যাঁ বলে। যদি ভবন করতে দেবেই না, তাহলে কাউকে দেবে না।

আব্দুস সাত্তার নামে আরেক বৃদ্ধ বলেন, বাবা আমাদের টাকা কম, তাই বাড়ি করতেও অনুমতি পাই না। অথচ বিদেশিরা এসে বিল্ডিং বানায় তখন পরিবেশ অধিদফতরের দেখা মেলে না।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, আমার চোখের সামনেই এখানে ইসিএ লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। অথচ সেন্টমার্টিনের স্থানীয় লোকজন কিছু করতে গেলেই বলে নিষিদ্ধ। আমার প্রশ্ন, ইসিএ শুধু সেন্টমার্টিনের স্থানীয়দের জন্য কেন?

তাঁর সংগে একমত প্রকাশ করে সমুদ্র বিষয়ক পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ আওয়ার সি'র মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, ইসিএ এলাকায় কোনো ভবন তোলার অনুমতি দেওয়াই ঠিক হয়নি। মেনে নিলাম, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং পরিবেশ অধিদফতর কাজের স্বার্থে ভবন করেছে। তাই বলে একটা ক্রিটিক্যাল এলাকায় এতোগুলো ভবন তুলবে? আমি তো পরিবেশ অধিদফতরের এতো ভবনের কোনো যৌক্তিকতা দেখি না।

তিনি বলেন, ইসিএ আইন শুধু কাগজে-কলমে আছে। এটাকে ব্যবহার করে শুধু প্রকল্পই হয়েছে। বাস্তবায়ন হয়নি একটুও।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফিক ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মোসলেম উদ্দীন মুন্না বলেন, আমি বলবো এটা নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একদিকে ইসিএ বলছেন, অন্যদিকে ভবন তুলতে দিচ্ছেন। এটা হতে পারে না। ইসিএ বাস্তবায়ন করা না গেলে ঘোষণা দেওয়াই ঠিক হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, আমাদের দেশ উল্টো সিস্টেমে চলে। যার ক্ষমতা আছে সে-ই অপব্যবহার করে। যাদের আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা আইনের সুযোগে  অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বাড়তি আয় করে। স্থানীয়দের টাকা কম, তারা বাড়তি টাকা দিতে পারে না বলে সুবিধাও পায় না। আবার আইন নিয়ন্ত্রণকারীরাও আইন ভাঙে। এদের চিহ্নিত করে বিচার করা দরকার।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জমান বলেন, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয় যে, আইনের রক্ষক নিজেই আইন ভাঙবেন। কাজের স্বার্থে থাকার জন্য ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। কিন্তু সেজন্য এতোগুলো ভবন তুলতে হবে কেন, বুঝলাম না।

তিনি বলেন, এসব করে তারা শুধু আইনই ভাঙে না, দুর্নীতিও করে। কিন্তু এদের কোনো জবাবদিহিতা চাওয়া হয় না। তাদের যে মন্ত্রণালয় রয়েছে, তারা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলে এই পরিস্থিতি হতো না।

 

আরও পড়ুনঃ পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-১ >> প্রকল্পের ১২ কোটি টাকা ফুরিয়েও ক্রিটিক্যাল এলাকায় পুড়ছে প্লাস্টিক

আরও পড়ুনঃ পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-২ >> সেন্টমার্টিনঃ সংরক্ষণ প্রকল্পের মধ্যেই চলেছে ধ্বংসযজ্ঞ

আরও পড়ুনঃ পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-৩>>৭ কোটি টাকার প্রচারণাঃ তবু কেউ জানে না, কেউ মানে না (ভিডিও)

 

** এরপর ৫ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ৫ম পর্ব প্রকাশিত হবে বিভিনিউজ২৪-এ। 

বিভি/রিসি 

মন্তব্য করুন: