• NEWS PORTAL

বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

নিঃসঙ্গতা ভয়াবহ

মনজুরুল হক

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১ অক্টোবর ২০২৩

ফন্ট সাইজ
নিঃসঙ্গতা ভয়াবহ

নিঃসঙ্গতা কত ভয়াবহ হলে নিঃসঙ্গ মানুষটি একটা ভলিবলকে Wilson নাম দেয় এবং তার সঙ্গে কথা বলে..., এমনকি তার সঙ্গে জরুরি মতবিনিময়ও করে। এই দৃশ্যটি দেখা যায় টম হ্যাঙ্কস অভিনিত Cast Away মুভিতে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজডুবিতে হারিয়ে চার্লিস চাক নোল্যান্ড একটা জনমানবহীন দ্বীপ 'মনুরিকি'তে গিয়ে ওঠে। জনমানবহীন দ্বীপে সে একা! তখন সাথে থাকা জিনিসপত্রের মধ্যে একটা ভলিবল পায়। সেই বলটার গায়ে চোখ-মুখ এঁকে মানুষের আদল দিয়ে তার ডেঁরায় একটা খুঁটির ওপর বসিয়ে রাখে।



রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমোনোর আগে চাক বলে-‘তোমার কি ঘুম পেয়েছে মি. উইলসন?’
উইলসন হয়ত বাতাসে একটু দুলে উঠল... চাক ভাবল উইলসন ‘হ্যাঁ’ বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সেও বলল-‘আমারও’।
শেষ দিকে একটা ভেলা ভাসিয়ে চাক ভূমণ্ডলের খোঁজে বেরিয়ে আবারও ঝড়ের কবলে পড়ে এবং উইলসন ঝড়ের তোড়ে ভেসে যায়। তাকে হারানোর ব্যথায় চাক শিশুর মত ডুকরে কাঁদতে থাকে.....

আমার প্রায়শঃই চাক নোল্যান্ডের কথা মনে পড়ে। ও জনমানবহীন দ্বীপে একা ছিল, তাই নিঃসঙ্গ। আমি জনমানবময় ঘরে-বাইরেও একা এবং নিঃসঙ্গ। না, এটা শুধু পাশে কেউ না থাকার নিঃসঙ্গতা নয়। এই নিঃসঙ্গতা চিন্তা-চেতনার। মতাদর্শের। মূল্যবোধের। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এবং জীবন-যাপননাচারের। ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে থেকেও এই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি নেই।

আমরা যারা দরিদ্রক্লিষ্ট পরিবারে জন্মেছি, সেখানে কোনো ভালো পরিবেশ পাইনি। আমাদের বাড়ি গ্রাম-শহরে যেখানে হোক অনেকটা বস্তির মত। হতদরিদ্র লোকালয়। সেখানে রাতদিন চিৎকার চেচামেচি, সস্তা মদ খেয়ে মাতাল হওয়া, বউ পেটানো, অশ্রাব্য খিস্তি-খেউড়, মারামারি-কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটি আর অভাবে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে না ওঠায় অন্ধাকার জীবনের সঙ্গে বসবাস। ওইসব সময়ে আমাদের সাধ-আহ্ললাদ, চাওয়া-পাওয়া সব ম্যাটমেটে ধূসর আলোহীন হয়ে থাকত।

আপনি কী রাশি বিশ্বাস করেন? এই যেমন কুম্ভ-মীন-সিংহ-মেষ-ধনু কিংবা মিথুন? আমি করি না। তার পরও মনে হয় হয়ত আমার এমন এক রাশি ছিল যা বইপত্রে নেই! ধরা যাক সেই রাশির নাম ‘অবহেলা রাশি’। আমাদের বাড়ির পাশে এক মাছ বিক্রেতার আট-ন বছরের মেয়ে ছিল-নাম রাজা। মেয়ের নাম রাজা? হুম। আমরা অবশ্যি জানতাম তার নাম ‘আজা’। ওর বাবা-মা ছিল নদীয়া-শান্তিপুরের। তাই ‘রাজা’কে বলত-‘আজা’। সেই আজা বাড়ি থেকে আচার চুরি করে এনে খোকনকে দিত। রাগে অভিমানে মনে হতো আমি কি খোকনের চেয়ে দেখতে খারাপ ছিলাম? না তো। তবে? উত্তর নেই। রেবেকা আপা কি সুন্দর ফুল তুলে রুমাল বানিয়ে দিত শহিদুলকে! কই আমাকে তো কোনোদিন দেয়নি? ফরিদা বুবুর বিয়ে হয়ে গেলে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় এক গাদা মার্বেল দিয়ে গেছিল কবিরকে। আমাকে একটাও না! অথচ আমি তো দেখতে সুন্দর ছিলাম! ভদ্র, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি….

এই কষ্টগুলো ভুলেছি প্রাক যৌবনে সুনীলের কবিতা পড়ে….
“একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভেতরে রাস উৎসব
অবিরল রঙ্গের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পড়া ফর্সা রমণীরা কতরকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি।”

এভাবে প্রাক যৌবন, যৌবন পার করেছি একটার পর একটা বঞ্চনা আর অবহেলা বুকে করে। কখনও কখনও এমনও হয়েছে অকস্মাৎ কিছু জুটে গেলে এতটাই বিস্মিত হয়েছি যেন ভূবিশ্বে এমন আর ঘটেনি। এখনকার প্রৌঢ়বেলায় এসেও সেই রয়্যাল গুলি কিনতে না-পারার কষ্ট আমার ক্ষতবিক্ষত করে। আর সব কিছু পাশে সরিয়ে রেখে যদি আমার লেখক বৃত্তি ধরি, যা দিয়ে এই সমাজে একটু-আধটু খাতিরটাতির পাওয়া যায়, আমার তো তাও জোটেনি। 

আচ্ছা, না হয় আমার কবিতার বই নেই, তাই কবিকুলের কোথাও কেউ আমায় ডাকে না, কিন্তু গল্প-উপন্যাসও তো লিখেছি! কই, কোনো সাহিত্য পরিষদ কিংবা সাহিত্যাসরেও তো কেউ ডাকেনি! এইসব আসরটাসর তো ফি মাসেই হয়। পেল্লাই সব চা-কফির আসর বসে। গোলাপী-নীল মিঠে আলোয় সুশ্রীজনেরা কবিতা পাঠ করেন। ছবি তোলেন। অনলাইনে প্রচার করেনে। একটিবারের জন্যও তো কেউ মনে করেনি এই হতচ্ছাড়াটাও খানাকতক বইটই লিখেছে!
ও, রাজনৈতিক গবেষণাধর্মী, বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখি, সেগুলো সাহিত্য ঘরানায় পড়ে না? তাহলে গবেষক, প্রাবন্ধিক কিংবা কলাম লেখকদের সঙ্ঘেও তো কেউ ডাকেনি! কেন? উত্তর নেই।

কয়েক মাস আগে একটা আধুনিক বই বিক্রির প্রতিষ্ঠানে গেলাম। তাদেরই প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত আমার বকেটি বইও শেলফে নেই। এক কাপ চাও জুটল না। উল্টো ম্যানেজারকে ডেকে বন্ধুসহ ফালুদা খাওয়ালাম। ওদেরই আরেকটি শোরুমে যে লেখকের মাত্র ৩টি বই আছে, তার নামেও একটি শেলফ আছে। শেলফে ওই লেখকের নাম সাঁটা। আমার বার-তেরটা বই। আমার নামে কোনো শেলফ নেই! অথচ অন্য লেখকরা ওই শাখায় গেলে ফুলেল অভ্যর্থনা পায়। বিরিয়ানিটিরিয়ানি এনে খাওয়ায়। আমার বেলায় এমন বৈমাত্রীয় আচরণ কেন? উত্তর নেই। আমি জানি। কারণ সেই রাশি; ‘অবহেলা রাশি’!

অবহেলা রাশির অবজ্ঞা পক্ষে আমার জন্য বরাদ্দ কিছু নেই। অথচ আকাশে পুরো পনেরটা দিন ধরে শুক্লপক্ষ চলে! শুক্লপক্ষ পেরিয়ে চন্দ্রভূক অমাবশ্যায় আমার জন্য বরাদ্দ পুরোটা মাসজুড়ে কৃষ্ণপক্ষ। অমন কৃষ্ণপক্ষে চাঁদ না থাকলে অর্বুদ অর্বুদ তারকারাজির দেখা মেলার কথা, অথচ অবহেলা রাশির কারণে আমার আকাশে কোনো তারকারাজিও নেই। আছে ধূসর নিয়ন বাতির ম্যাড়মেড়ে অনুজ্জ্বল আলো। যে আলোয় আমিই আমার মুখ পুরোপুরি স্পষ্ট দেখি না। 

গুণিজনেরা বলেন-প্রকৃত লেখকদের প্রচারবিমুখ হতে হয়। কে ডাকল আর কে ডাকল না সেসব নিয়ে ভাবে সস্তা লেখক, কবি-সাহিত্যকরা। আমি বলি ভাই; ‘প্রচারবিমুখ’ শব্দটাই ভীষণরকম প্রচারকৌশল। আমার ওই প্রচারবিমুখ তকমারও দরকার নেই। ডাকেনি তো ডাকেনি। কী যায়-আসে? আমার লেখাই এখন আর আমাকে সেভাবে ‘ডাকে’ না। এটা ভাবলেই নিজের ওপর ঘেন্না আসে। মনকে বলি-কে তোমার বই শেলফে রাখল না, কে তোমাকে পরোটা-মাংস এনে আপ্যায়ন করল না, কে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানাল না, কে রয়্যাল গুলি দিল না, বাড়ি থেকে আচার চুরি করে দিল না….ওসব ভেবে লেখায় বিরতী দিও না। তোমার ভেতর যে কথা গুমরে মরে, তাকে লেখার মাধ্যমে জীবন দিতে থাকো। লেখারাই একদিন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

ও হ্যাঁ, চার্লিস চাক নোল্যান্ডকে একসময় একটা জাহাজের লোকজন মুমূর্ষূ অবস্থায় সাগরে ভাসতে দেখে তুলে নেয়। নিজ শহরে ফিরে চাক তার বান্ধবী কেলী ফ্রেয়ার্স লভেট্টির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখে তার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করছে…., কারণ সবাই জানত চাক অনেক আগে মারা গেছে! চাক ফিরে আসে। হাঁটতে হাঁটতে একটা চৌরাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। কোনদিকে যাবে? জানে না….ফেডআউট। কাট।

মন্তব্য করুন: