• NEWS PORTAL

  • রবিবার, ১১ মে ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

সার্বজনীন হোক শারদীয় দুর্গোৎসব

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা 

প্রকাশিত: ১১:৪১, ২০ অক্টোবর ২০২৩

ফন্ট সাইজ
সার্বজনীন হোক শারদীয় দুর্গোৎসব

বছরব্যাপী অপেক্ষার প্রহর শেষে শুরু হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘শারদীয় দুর্গোৎসব’। দেবী দুর্গাকে দুষ্টের বিনাশ ও সৃষ্টের পালনে করা হয় দেবীর বোধন পূজা। শাস্ত্রমতে, বোধন কথার অর্থ হলো জাগ্রত করা। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের সময় দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন রামচন্দ্র। সেটা ছিল দেবীর অকালবোধন। 

শাস্ত্রমতে বলা হয়- সপ্তমীতে দেবী দুর্গার আগমন এবং দশমীতে গমন হয়। আর দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন ও গমন যে বাহনে, তার ওপর নির্ভর করে গোটা বছর পৃথিবীবাসীর কেমন কাটবে। এ বছর দেবীর আগমন ও গমন দুটোই ঘোটকে। যার অর্থ ছত্রভঙ্গ। কোনো বছর দেবীর আগমন ও গমন একই বাহনে হলে তা অত্যন্ত অশুভ।  

প্রতি বছরের মতো এবারো দুর্গোৎসবকে ঘিরে দেশব্যাপী দেখা গেছে আনন্দ-উৎসবের ফল্গুধারা। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আনন্দ উৎসব করছে বিশ্ববাসী। অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভশক্তির অভ্যুদয় দুর্গা আরাধনার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত। যুগের বিবর্তনে দুর্গোৎসব বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। বাঙালি ঐতিহ্যগতভাবেই উৎসবপ্রিয়। ঈদ ও পূজা ঘিরে জাতীয় জীবনে যে আবেগ সৃষ্টি হয় তা এ সত্যকেই তুলে ধরে। এক সম্প্রদায়ের উৎসবে অন্য সম্প্রদায়ের উপস্থিতি জাতীয় ঐক্যকেই সুসংহত করে। 

সত্য ও শুভর জয়- এই হচ্ছে সব ধর্মের মর্মকথা। অশুভ অসুর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুভ দেবশক্তির চূড়ান্ত বিজয়ের দিন হিসেবেই দুর্গাপূজার দশমীর দিনটিকে বলা হয় ‘বিজয়া দশমী’। অসুরকুলের দম্ভ-দৌরাত্ম্য থেকে দেবকুলকে রক্ষায় মাতৃরূপী ও শক্তিরূপী দেবী দুর্গার আগমন। অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা দেবকুলকে রক্ষা করেন। অন্যায় ও অশুভকে পরাস্ত করার মাধ্যমে ন্যায় ও শুভবোধের প্রতিষ্ঠা ঘটে। দেবী দুর্গা সত্য, শুভ ও ন্যায়ের পক্ষের সংগ্রামে মর্তের মানুষকেও সাহসী করে তোলেন। দূর করে দেন যত গ্লানি, হিংসা-দ্বেষ, মনের দৈন্য ও কলুষ। যাবতীয় মহৎ গুণাবলির প্রতি দেবী দুর্গা মানুষকে আকৃষ্ট করেন। ফলে সত্য শুভ ও কল্যাণের এক গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব হয়ে ওঠে সার্বজনীন।

দূর্গা পূজা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ নানাভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যাবতীয় দুঃখ ভুলে গিয়ে হিংসা-বিদ্বেষের উর্ধ্বে উঠে প্রীতির মেলবন্ধন রচনার মাধ্যমে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাই দূর্গা পূজা হিন্দু সমাজে সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বিবেচিত। দেবী দূর্গা বিভিন্নরূপে এই মর্তের পৃথিবীতে আবির্ভুত হয়ে থাকেন এবং আমাদের সার্বিক মঙ্গল নিশ্চিত করেন বিধায় তিনি সর্বমঙ্গলা। আবার শিবের শক্তি বলেও তিনি শিবা। কারণ তিনি সকল প্রার্থনা এবং আরাধনা মঞ্জুর করেন এবং অসাধ্যকে সাধন করেন। তাই তিনি শরণ্য, তিনি গৌরী। দূর্গা দশভূজ নামেও পূজিত এবং আরোধিত হয়ে থাকেন।

দেশব্যাপী বইছে নির্মল সম্প্রীতি থেকে উৎসারিত উৎসবের ফল্গুধারা। সাড়ম্বরে দুর্গোৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও কল্যাণময় অবস্থানের বিকাশ আরও বিস্তৃত এবং বিকশিত হবে। উপরন্তু অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে মঙ্গলদায়ক, শুভশক্তি ও ইতিবাচক চেতনার সম্প্রসারণ ঘটবে। 

অসুরের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। সেই থেকে বিজয় ঘটে শুভশক্তির। দেবীর আগমন ঘটে অন্যায়ের বিনাশ ঘটিয়ে সজ্জনদের প্রতিপালনের অঙ্গীকার নিয়ে মানুষের মধ্যে নৈতিক আদর্শ জাগ্রত করার জন্য। মানুষের চিত্ত থেকে যাবতীয় দীনতা ও কলুষতা দূরীভূত করার জন্য। এ জন্য দুর্গোৎসব ধর্মীয় উৎসব হলেও তা সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। সম্প্রদায়গত বিভেদের উর্ধে উঠে মানুষকে এক পরম আনন্দের সোপানে দাঁড় করাচ্ছে। শারদীয় দুর্গোৎসব সবার জন্য থাকে উন্মুক্ত। দেবী দুর্গার আগমনী আনন্দকে সবাই ভাগাভাগি করে নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ, বাঙালী জাতি নিরন্তর উন্মুক্ত উৎসবমুখর পথে চলতে পছন্দ করে।  

প্রতি শরতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বর্গলোক কৈলাস ছেড়ে মর্তে আসেন দেবী দুর্গা। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নির্দিষ্ট তিথি পর্যন্ত বাবার বাড়িতে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। দেবীর অবস্থানকালে পাঁচ দিন পৃথিবীতে ভক্তরা দেবী মায়ের বন্দনা করে। এই বন্দনাকে কেন্দ্র করে দেশবাসী মেতে ওঠে উৎসব আনন্দে। করোনার কারণে এবার পূজার অনুষ্ঠানমালা শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে মন্দির বা মণ্ডপ প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
 
ধর্ম মানুষে মানুষে প্রীতি, প্রেম, সহিষ্ণুতা, ঐক্য ও শান্তির ডাক দিয়ে যায়। তারপরও অসুরের আকস্মিক উন্মত্ততা নষ্ট করে দেয় আবহমানকালের প্রীতিধন্য পারস্পরিক অবস্থানকে, ধ্বংস করে দেয় দীর্ঘকালীন হৃদ্যতাকে। সৃষ্টি হয় বৈষম্য, বিভেদ, হিংসা, অন্যায় ও অকল্যাণ আর এ জন্যই মঙ্গলদাত্রী দেবী দুর্গার আগমন ঘটে কল্যাণ ও শান্তিকে সংস্থাপন করার জন্য এবং তা প্রতিবছরই। তিনি ন্যায়ের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে যান সবাইকে। সবাই তাঁর এই ডাকের অপেক্ষায় থাকেন ব্যাকুল হয়ে একটি বছর। সবার আশা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন থাকবে, দূর হয়ে যাবে সব সঙ্কীর্ণতা ও বিভেদ। কারণ এ দেশের ঐতিহ্যই হলো মানুষে মানুষে সম্প্রীতি রক্ষার।

মানুষের শাশ্বত যাত্রা খণ্ড থেকে অখণ্ডের দিকে। অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে। বিচ্ছিন্নতা থেকে ঐক্যের দিকে। মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধনই তাদের সমগ্রের দিকে ধাবিত করে। পৃথিবীর সব ধর্মে মানবিক সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। আধ্যাত্মিক দিক থেকেও আত্মিক শুচিতা ও বিশুদ্ধতা অর্জন এবং তা লালন করাই পরম লক্ষ্য। কিন্তু মানুষ কখনো কখনো সততা, বিশ্বাস ও ন্যায়নীতিতে অবিচল থাকতে পারে না। ক্রোধ-নিষ্ঠুরতা-জিঘাংসা বাসা বাঁধে মনে। এক অর্থে মহিষাসুর মানব মনের এই নেতিবাচকতা- যা মানুষকে নিয়ে যায় হিংসা, বিদ্বেষ আর কলুষতার পথে- তারই প্রতীক। দেবী দুর্গা তার শুভ আবির্ভাবে মানুষকে সেই পতন থেকে রক্ষা করেন।

বর্তমানে এ দেশে দুর্গোৎসব কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসব উদযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ সময়টাতে আগমনী সুর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালিকেই দোলা দিয়ে যায়। শরতের শুভ্র আকাশ, কাশফুলে হাওয়ার নাচন আর আগমনী ঢাক-শাঁখের আওয়াজ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গ্রাম-নগরে ধনী-গরিব ছোট-বড় সবাই মিলিত হন শরতের মিলনোৎসবে। দেশের মিডিয়াগুলোও এটিকে সার্বজনীন উৎসব গণ্য করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সাজায়। এটি অনুপম সম্প্রীতি চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। 

উৎসব-পার্বণ পালনের মধ্য দিয়েই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্যরে বন্ধন আরো দৃঢ় হোক। আমাদের মনের সব হিংসা, দ্বেষ, কালিমা দূর হয়ে যাক। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে আমরা সুখ ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাব- এই হোক প্রার্থনা।

লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড।

 

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

মন্তব্য করুন: