বার্মার বারুদে আক্রান্ত ঢাকা-দিল্লি
মিয়ানমারের সমস্যা এখন আর মিয়ারমার সীমানায় নেই। দেশটির অভ্যন্তরীণ বারুদপোড়া গন্ধ ভারত-বাংলাদেশসহ আশপাশেও। এ গন্ধের ঝাঁঝে চীন চিকন বুদ্ধিতে সাইড লাইন নিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ এবার সস্তাদরের মানবিকতার শো আপ করবে না। নতুন করে একজন রোহিঙ্গাকেও ঢুকতে দেবে না বলে সাফ কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতে ঢুকে পড়া মিয়ানমারের কিছু সেনা ও নাগরিককে পুশব্যাক করা হয়েছে। এ যন্ত্রণা কেউ নিতে চাচ্ছে না। সুদূর আটলান্টিকের ওপার থেকে পরিকল্পণা মতো খেলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা সেখানে বার্মা এ্যাক্ট বাস্তবায়ন থেকে এক চুলও সরছে না। সমস্যাটি এখন আর রাজনৈতিক থাকছে না। উপআঞ্চলিকতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে কৌশলগত বড় সার্কেলে।
মিয়ানমার সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ আশপাশও উত্তেজনাকর। সেখানকার বিদ্রোহী আরাকান আর্মি আর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গোলাগুলির শব্দ আছড়ে পড়ছে এখানে। ভয়-আতঙ্কে সীমান্ত ঘেঁষা ঘুমধুম-তুমব্রু এলাকার পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চবিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণার পর আবার খুলে দেয়া হয়েছে। দুই সীমান্তে আতঙ্কের মাঝে জোর টহল দিচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। সরকারের কঠোর নির্দেশনা মিয়ানমারের একজনও যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে। এ বিষ আর গিলতে চায় না সরকার। তখন যে আশা-প্রত্যাশায় রোহিঙ্গাদের টেনে নেয়া হয়েছিল, এবার সেই সমীকরণের ধারেকাছেও যেতে চায় না সরকার।
সরকারের নির্দেশণা মতো তৎপর বিজিবি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভয় দিচ্ছেন মানুষকে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কী অবস্থা যাচ্ছে, এর সামান্য তথ্যও বাইরে আসছে না। বিচ্ছিন্ন-বিলম্বিত যতসামান্য তথ্য নিয়েই যতো গবেষণা-বিশ্লেষণ বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোতে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে গুলি, ব্রিগেডিয়ার-জেনারেলসহ ৪ সামরিক কর্মকর্তা নিহত ছাড়াও বিদ্রোহীদের হাতে দেশটির সেনাবাহিনীর করুণ অবস্থার খবর গণমাধ্যমে আসে অনেক ফিল্টারিং শেষে।
ঘটনাটি থাই সীমান্ত এলাকার। সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার অবতরণের প্রস্তুতিকালে তাতে স্নাইপারদের গুলির খবরটি দুতিন দিন পর দিয়েছে সেনাবাহিনীর সূত্র উদ্ধৃত করে অনলাইন মিডিয়া ডন। এতে বলা হয়, এ ঘটনা ঘটে সোমবার থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে মায়াবতী শহরের কাছে থিঙ্গানিনাউঙ্গ শহরে। নিহত হয়েছেন একজন ব্রিগেডিয়া-জেনারেলসহ সেনাবাহিনীর সিনিয়র অন্য তিনজন সদস্য। খবরটি মোটেই পরিপূর্ণ নয়।
নিয়মিত মায়াবতীর আশপাশে এবং মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর জোট এবং মিত্র পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস গ্রুপের সঙ্গে তীব্র লড়াই চলছে সেনাদের। মিয়ানমারের দুর্ধর্ষ বলে কথিত সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে সমানে মার খাচ্ছে জাতিগত বিদ্রোহীদের হাতে। সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণ থেকে বহু এলাকা তারা কেড়ে নিয়েছে তারা। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মিদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর তীব্র লড়াইর অসম্ফূর্ণ খবর আসছে নানা ফাঁকফোকর মাড়িয়ে। মোটাদাগের খবর হচ্ছে, চাইনিজ মদদপুষ্ট সামরিক বাহিনী জাতিগত এই বিদ্রোহীদের সামনে টিকে থাকতে পারছে না। সামরিক জান্তা সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট শয়ে বেশ আগেই বলে রেখেছিলেন, এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। হাল নমুনা কিছুটা তেমনই। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর মাধ্যমে অং সান সুচিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা অং মিন হ্লাইং। তারপর থেকেই এসব বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে থেমে থেমে লড়াই চলছিল। সম্প্রতি লড়াইর ভয়াবহতা ব্যাপক। অভ্যুত্থানের পর এমন চ্যালেঞ্জের মুখে আর পড়েনি মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
এ অবস্থায় আসিয়ান একজন বিশেষ দূতকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিয়ানমারের জনগণের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দূত হলেন আলোনকেও কিত্তিখোউন। তিনি এ মাসের শুরুর দিকে মিয়ানমার সফর করে সামরিক জান্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু, ফলেঅ আপ তথ্য নেই। চীন মাঝেমধ্যে শান্ত হওয়ার ছবক দেয়। সংঘাত বন্ধে অস্ত্রবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করে আবার চেপে যায়। তারা দুদিকেই থাকে। মিয়ানমারে অস্ত্রসরবরাহ আগের চেয়ে কমিয়েছে। আবার গোপনে বিদ্রোহীদের দুয়েকটি গ্রুপকেও অস্ত্র দেয়। সব নখদর্পনে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের। কলকাঠিও নাড়ে। জান্তা সরকারের বিকল্প হিসেবে গঠিত তথাকথিত জাতীয় ঐক্যের সরকারের সঙ্গে এখন বাইডেন প্রশাসন গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার বার্মা অ্যাক্টের আওতায় মিয়ানমারের ছায়া সরকারের সশস্ত্র বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স, জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন এবং গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপগুলোকে ‘নন-লেথাল এইড’ বা ‘প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র সরঞ্জাম’ দিয়ে যাচ্ছে। বাদবাকিরা হয় শিকার, নয় দর্শক।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে মার্কিন সহায়তার দান শুরু হওয়ার পর থেকে বিদ্রোহীদের হামলা তীব্র থেকে তীব্রতর। এতে বেসামরিক অনেক নাগরিকেরও মৃত্যু হচ্ছে। এর ধাক্কা গিয়ে পড়ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে। সীমান্ত এলাকার কয়েকটি শহর এবং কয়েক ডজন সামরিক ঘাঁটি দখলের জেরে ক’দিন আগে ৭২ জন সেনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এরইমধ্যে মিয়ানমার থেকে চিন জাতিগোষ্ঠীর ৩২ হাজারের বেশি লোক ভারতের চিন-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে তাদের বেশির ভাগই শরণার্থীশিবিরে কাটাচ্ছে। ভারতের মণিপুর রাজ্যেও হাজার হাজার লোক পালিয়ে গেছে। এ নিয়ে মণিপুরের স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির অবস্থান বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি। বাংলাদেশের জন্য এটি উদ্বেগের। ভারতের জন্যও লাল সংকেত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বার্মা এক্ট ভারতকে এরইমধ্যে বিপদে ফেলেছে। মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত। প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ড সীমান্তে জড় হয়েছে তাদের অনেকে। তাদের এই দুর্দশার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নেই বললেই চলে।
লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোষ্ট
মন্তব্য করুন: