অর্থের নিদারুণ অনর্থের শিকার বাংলাদেশ
বাজারের আগুনে মানুষ পুড়ছে। কতো যে অজুহাত। বৈশ্বিক দোহাই। মানুষের মাথাপিছু আয়-ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রমজান, ঈদ-চাঁদ। যুদ্ধ, শীত, মহামারি, ডলার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও কতো কী? মুনাফা শিকারি বা সরকারের ব্যর্থতার কথা বলা যাবে না। পাকিস্তানিরা যা পারেনি, তা করে ছাড়ছে কতেক স্বদেশি। বঙ্গ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরও জোরদার হবার প্রেক্ষিত তৈরি করতে পেরেছে তারা। এতে দেশের কী সর্বনাশ হচ্ছে, সরকার কোন দুর্গতিতে পড়ছে তা তাদের দেখার বিষয় নয়। তারা সওয়ারি মাত্র। সরকারের ওপর সওয়ার হয়েছে।
সরকার পরিস্থিতি উৎরানোর চেষ্টা কম করছে না। এদিক টানলে ওদিক ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা সংকট কাটাতে ১৮ কোটি মানুষের মোট চাহিদার বিপরীতে আমদানি কড়াকড়ি করেছে সরকার। বিগত এক-দেড় বছরে সকল পণ্যের (চাহিদার ১০০% - আমদানির স্থলে) ২০% কমে গিয়ে ৮০% আমদানি হয়েছে। চলতি ৩ মাসে আমদানি আরও কমে গিয়ে ৩০% -এ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১০০% চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৬৭% দিয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষ বিগত দিনগুলোতে তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়েছে। তা করেছে নির্ধারিত আয়ের বাইরে বিকল্প পথে বা ধার-দেনা করে। অথবা ক্রয়ক্ষমতা হারানোর ফলে ব্যক্তির বা পরিবারের মাত্রাতিরিক্ত কৃচ্ছসাধনে।
কৃচ্ছাতার কারণে ৩ মাসে আমদানি ৩৩% কম হওয়ায় কাগজে-কলমে ৩০ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় সরকারের ঘরে কিন্তু নগদে এ মুহূর্তে সরকারের হাতে ২০ বিলিয়নেরও কম! কাজীর গরু খাতায় আছে-গোয়ালে নেই অবস্থা। ৩৩ বিলিয়ন কৃচ্ছসাধনে সঞ্চয় অথচ বাস্তবে হাতে নগদ ২০ বিলিয়ন ডলার ! এর সাথে আগামী ৩ মাসের চলমান রেমিট্যান্স, রফতানি আয়, ঋণ পরিশোধ, ঋণ গ্রহণ হিসাবের বাইরে? আগামী ৩ মাস নিত্যপণ্যের আমদানির জন্য এই ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় ধরলে ১৮ কোটি মানুষের শতভাগ চাহিদার বিপরীতে কত শতাংশ আমদানি করা যাবে? ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে কতশত-হাজার-লাখ বেকার সৃষ্টি হবে সে হিসাব বাদ দিয়ে ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডে জীবন কাটানো নব্য প্রায় ৫ কোটি মানুষকেও হিসাবে আনতে বারণ? প্রশ্নও করা যাবে না?
হিসাবের এ ফাঁকফোকর ও অর্থ সঙ্কটের সুযোগটাই নিচ্ছে বন্ধুরূপী বিদেশিরা। চীন আরও আরও দেবে বলে জানান দিচ্ছে। ডলার সঙ্কটে পাশে দাঁড়াবে বলে আগ বাড়িয়ে ভরসা দিচ্ছে। আমরা এগুলোকে পজেটিভ সংবাদ হিসেবে প্রচার করছি। আমাদের যখন সঙ্কটই নাই, তখন চীন বা অন্য কোনো দেশ সহায়তার আশ্বাস দেয় কেন? এই সাহস কই পায় তারা? আমাদের ফাঁক বা লুকোচুরির সুযোগে? মাত্র ২১ দিনে রিজার্ভ কমে পৌনে দুই বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ার তথ্য কতোক্ষণ লুকানো যায়? এ সংকট উত্তরণে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ছে না বা বাড়ানো যাচ্ছে না। আমদানির চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন রিজার্ভের খুব খারাপ বার্তা দিচ্ছে। তাদের হিসাব মতে, ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভ কমে ঠেকেছে ২ হাজার ৫৩৩ কোটি (২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন) ডলারে। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী বিপিএম-৬ মেথডের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ৫২১ কোটি (৫.২১ বিলিয়ন) ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ এখন ২ হাজার ২ কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। ২১ দিনে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৭৭ কোটি ডলার ( ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) এবং বিপিএম-৬ অনুযায়ী কমেছে ১৭২ কোটি ডলার (১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন)। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৯.৭৩ বিলিয়ন ডলার আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২৩ দশমকি ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়, প্রকাশ করা হয় না।
টাকার অভাব, ডলার–সংকট না থাকলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওনা এবং বিদেশিদের বকেয়া শোধ করা যাচ্ছে না কেন? বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিপুল পরিমাণ দেনা নিয়ে আমরা বিপাকে পড়ছি কেন? সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া সর্বশেষ হিসাবে, দেশে উৎপাদনরত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। মার্চে গরমের মৌসুম শুরু হচ্ছে। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হবে, আমদানি বাড়াতে হবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল। টাকার অভাব ও ডলার–সংকটের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও অপরাধ হয়ে যাবে?
হিসাব প্রকাশ-অপ্রকাশ, প্রদর্শন-অপ্রদর্শনের এ কানাগলিতে যা হবার হয়ে চলছে। বাংলাদেশ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার ভারতে রেমিট্যান্স যাওয়ার তথ্য কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। তারা না ভীষণ ধনী দেশ? প্রতিবেশী গরিব-কাঙ্গালের ধনে হাত দেয় কেন? এখানে কাজ খুঁজতে আসে কেন? অসংখ্য বাংলাদেশি বেকার থাকলেও বাংলাদেশের শ্রম বাজারে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় কাজ করছে। তারা আনডকুমেন্টেড। ডকুমেন্টেড করলে নাকি ঝামেলা আছে ৷ সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন ‘ডয়চে ভেলের টক শোতে এ বিষয়ে যতসামান্য তথ্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের সাথে ভারতের অসম বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ভারতের সাথে রফতানি বেড়েছে অল্প, সেক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে রফতানি বেড়েছে অনেক৷
তথ্যের লুকোচুরি বিপদ ডেকে আনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ধার করে ঘি খাওয়ার ফুটানির পরিণতিও ভালো হয় না। সব কিছুতে অজুহাত খোঁজা সমস্যাকে আরও জটিল করে। নানা কালো হাতের কারসাজি চাঙ্গা হয়। যার নজির চলছে দেশের পুঁজিবাজারে। এই মাঘেও শেয়ার বাজারে কারো পৌষ মাস আবার অনেকেরই সর্বনাশ চলছে। কারও পোড়া ঘরে কেউ
কেউ আলু পোড়া খাচ্ছে। রাজনীতির মাঠে চাতুরিতে অনেক কিছু সফল করা যায়। দলীয় স্বতন্ত্র রিজার্ভ ফোর্স, অনুগত দল বিরোধীদল, আজ্ঞাবহ ট্রেডবডি, পেশাজীবি সুশীল দিয়ে বাহ-বেশ আদায় করা যায়। অর্থনৈতিক ঘোর অর্থনৈতিকভাবেই হ্যান্ডেল করতে হয়। চাতুরিতে অর্থনৈতিক সমাধান আসে না। বিশ্বের বহু দেশ এর নির্মম শিকার।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোস্ট ও কলামিস্ট
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: