তাপে-চাপে গরমের ভাইরাল চরমে
মোস্তফা কামাল
এটা না সেটা, কিছু একটা সামনে এনে আলোচনায় থাকা বা আলোচনায় রাখার বাতিক সমাজ-সংসার, রাজনীতি-অর্থনীতি সবখানেই। ‘কাজ নাই তো খই ভাজ’র মতো তারা ধর্ম-কর্ম, ভাষা-শব্দকেও ছাড় দেন না। প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত শব্দ-বানানকে বেশ চাতুরির সাথে সামনে নিয়ে আসতে পারঙ্গম তারা। হিট স্ট্রোক বা এই মাথা ফাটা চরম গরমও তাদের দমাতে পারে না। বরং যেন আরও জোস আনছে। আরও বাড়বাড়ন্ত এই ভাইরাল ভাইয়েরা। তাপকেও ভাইরালের সাবজেক্ট করে ফেলা হয়েছে বেশ মুন্সিয়ানায়। তাপদাহ না দাবদাহ কোনটা সঠিক? –এ প্রশ্ন সামনে এনে তাদের কারসাজিতে গত কদিন ক্যাচাল তুঙ্গে।
গণমাধ্যমে তাপদাহ-দাবদাহ হরদম চলছে। তা থেকে গরম এবং তাপের তীব্রতা বুঝে নিচ্ছেন পাঠক-শ্রোতা-দর্শকরা। কাউর বাধানোর মতো আবহাওয়া অধিদপ্তর সেখানে যোগ করেছে তাপপ্রবাহ। তাদের নোট-ফুটনোট, প্রেসব্রিফিং- প্রেসরিলিজে তাপপ্রবাহ ব্যবহার হচ্ছে। এর জেরে গণমাধ্যমে তাপদাহ, দাবদাহ, তাপপ্রবাহ তিনটা তো চলছেই, সেইসঙ্গে গরমের ব্যাপকতা-তীব্রতা বোঝাতে নানা বিশেষণ যোগ করা হচ্ছে। কিন্তু ভাইরাল কমিউনিটি হাল ছাড়ছে না। লেগেছে আঠার মতো। ‘তাপদাহ’ না ’দাবদাহ’ কোনটা সঠিক – এ প্রশ্ন ছুঁড়েই চলছে। এমন কি এগুলোর কোনটার উচ্চারণ কী সেই বাহাসও উসকে দিচ্ছে। তা চলছে ম্যারাথনে। কনফিউশন কমাতে গিয়ে কনফিউশন আরও বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তারা এরইমধ্যে বেশ সফল।
আবহাওয়া বিভাগ ইংরেজি হিট ওয়েদার এর অনুকরণে তাপপ্রবাহ লছে-লিখছে। এটি তাদের নিজস্ব পরিভাষা। গরমে তাপপ্রবাহ। শীতে ‘শৈত্যপ্রবাহ’। গরমের ক্ষেত্রে বাংলায় তাপপ্রবাহ দিয়ে অর্থ পরিপূর্ণ হয় না। এতে গরমের বিষয়টি উহ্য থাকছে। কারণ তাপপ্রবাহ মানে তাপের প্রবাহ। আর তাপের প্রবাহ শীত-গরম সব সময়ই চলমান। আর দাহ বলতে বাঙালিরা দহনই বোঝে। প্রায়োগিকভাবে তাদের কাছে তাপ আর উত্তাপ-এর একই অর্থ। গোলমাল বাঁধছে ব্যাকরণে। ‘তাপদাহ‘ সমাসবদ্ধ শব্দ। সাধারণ সমাসে ‘তাপের যে দাহ’। এখানে তাপ কিন্তু উত্তাপ নয়। তাপ এখানে তপ বা সূর্য্য। তাই তাপদাহ এখানে ‘তাপ দ্বারা দাহ’।
দাবদাহও একটি তাপের বিষয়। তবে ফের আছে। আগ্নেয়গিরি বা অতিরিক্ত রোদের তাপে পৃথিবীর কোনো অঞ্চলে বন জঙ্গলের গাছপালা শুষ্ক হয়ে তাতে আগুন ধরলে তাকে দাবানল বলে। আর সেই দাবানলের কারণে পরিবেশ উত্তপ্ত হলে বলা হয় দাবদাহ। বোধ দিয়ে আসল কথা। তাপদাহ, দাবদাহ আর তাপপ্রবাহ দিয়ে মানুষ গরমের যন্ত্রণা-তাড়নাই বোঝে। বোধের প্রশ্নে এতে ভুল নেই। কারণ ভাষা বা শব্দ যোগাযোগের হাতিয়ার। বুঝতে পারা দিয়েই আসল কথা। কখনো কখনো যা সবসময় অভিধানে থাকে না। তাপের দাহ, দহন, দাবড়ানি মিলে তাপদহ, তাপদাহ, দাবদাহ শব্দগুলো মানুষের মুখে প্রচলিত। প্রায়োগিকভাবে কোনোটিকেই ভুল বলে উড়িয়ে দেয়া শোভন নয়। আবার আরোপ করাও কাম্য নয়। সমস্যাটা হচ্ছে আরোপ বা চাপানো নিয়ে। ইদ-ঈদ, রমজান-রমাদান নিয়েও এ কাণ্ড কম চলেনি। মোহাম্মদ, মহম্মদ, মুহম্মদ নিয়ে তো চলছেই। মাঝেমধ্যে টোকা দিলে আরও জমে। এই তো কিছুদিন আগেও চলেছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা আর আনন্দ শোভাযাত্রা নিয়ে। এগুলো যে ছক মতো সাজানো-পরিকল্পিত-আরোপিত তা বুঝতে বাংলাবিশারদ হওয়া জরুরি নয়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই তা বোধগম্য। ধারণাই করা যায়, চলমান তাপদাহ-তাপদহ-তাপপ্রবাহ-দাবদাহ ক্যাচালও বেশিদিন চলবে না।
মানুষ সবসময়ই প্রয়োজনেই নতুন শব্দ তৈরি করে। তা এক সময় অভিধানের কোনো সংস্করণেও জায়গা করে নেয়। অথবা অভিধানে জায়গা না পেলেও ব্যবহারে-প্রয়োগে শক্তিমান হয়ে ওঠে। মঙ্গল আর আনন্দের মাঝে কি অনেক তফাৎ? মুখের ভাষা ‘তাপদাহ’ আর আভিধানিক ‘দাবদাহ’-এর কোনোটাকে কি ব্যবহারে আটকে রাখা যাচ্ছে? তা সম্ভবও নয়। হুটহাট বানান বা শব্দ বদলানো স্মার্টনেস নয়। তা শব্দের অর্থও বদলে দিতে পারে। আবার জোরজবরদস্তি করে আদি শব্দ ধরে রাখাও মার্জিত নয়। এতে নতুন-পুরানে ভাষায় বিশৃঙ্খলা বাড়বে। বেশি বিকল্প শিশুদের জন্য ভালো নয়। ভিন্ন ভাষার যারা বাংলা শিখছে তাদেরও খটকায় ফেলবে। অতি বানান ও শব্দ দেখে তাদের বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। তখন তাদের কাছে ইংরেজিকেই সহজ-সাবলীল ভাষা মনে হবে।
বাংলা ভাষায় শব্দের জাত বিচার সম্পর্কিত তাত্ত্বিক কিছু সমস্যা তো রয়েছেই। যা বাংলা বানান ও শব্দের নিয়মের ক্ষেত্রে জটিলতা পাকায়। তারপরও মাঝেমধ্যেই বাহাদুরি ফলাতে বা ভাইরাল হতে ছুঁতা টেনে আনা বাংলার প্রতি নিষ্ঠুরতা। প্রথাগতভাবে বাংলা শব্দকে পণ্ডিতেরা ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি-এই চার ভাগ করেছেন। অর্ধ-তৎসম নাম দিয়ে আরেকটি ভাগও টানা হয়েছে। এসব ভাগ-বিভাজন অমান্য করা যাচ্ছে না। আবার আঁকড়ে থেকে বাস্তবতাকে না মেনে নিজের শব্দভাণ্ডার ছোট করে ভাষাগতভাবে দরিদ্র হওয়াও কাম্য নয়। ভেজাল বাঁধছে গরমে আর শীতে, ঈদে বা আনন্দে অভাবে বা স্বভাবে বদনিয়তে শব্দ বা বানানকে জোর করে সামনে আনায়। তারওপর ভাইরাল ব্যারামে গণ্ডগোলের জায়গা তৈরি করা। এ ব্যারাম বড় ভয়ঙ্কর।
প্রত্যেক মানুষ তার অবস্থান জানান দিতে চায়। আবার সম্মানের সঙ্গে বাঁচতেও চায়। কিন্তু, এই ভাইরাল রোগ নিজের সম্মান নিজে হানি করতেও বিবেকে বাধে না। তাদের কাছে ভাইরাল হওয়া দিয়েই কথা। সেটা করতে গিয়ে তারা বানান, উচ্চারণ, শব্দসহ গোটা ভাষা নিয়েও টান মারছেন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: