জোরাজুরির বাসর: ফের ব্যাংক হ্যাকিংয়ের হিন্দি খবর

মোস্তফা কামাল
জোরাজুরিতে এক ব্যাংককে বিয়ে পড়িয়ে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে আরেক ব্যাংকের কোলে। ঘটক বড় কড়া। কবুল বলিয়ে ছাড়বেই। তাই ধর্ষিত হওয়ার চেয়ে উপভোগই উত্তম-এ তরিকায় ম্যারেজ বরণ। ব্যাংকিং ভাষায় মার্জার। খাস বাংলায় একীভূত। হোক তা দুর্বলের ইচ্ছায়, সবলের অনিচ্ছায়। মঞ্চে হাসিমুখে ‘কবুল’ বলতেই হচ্ছে। দেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এতো ব্যাংক দরকার কি-না, এক সময় এ প্রশ্ন ছিল। জবাবে বলা হয়েছিল, এটি উন্নতির লক্ষণ। ব্যাংক থাকতে পারবে-এ প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ অনেকের রক্তচক্ষু দেখতে হয়েছে। উপরন্তু বলা হয়েছে, এগুলো উন্নয়নের লক্ষণ। দেশের অর্থনীতির বিশালত্বের প্রকাশ। এখন বলা হচ্ছে, ব্যাংকিং সেক্টরকে বাঁচাতে হলে মার্জ করতেই হবে। মানে কথা আগেরটা শুদ্ধ। এখনকারটা আরও শুদ্ধ। এই সুদ্ধাশুদ্ধির ফাঁকে আবার সেই পুরনো হ্যাকিং কাণ্ড।
একদিকে বলা হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর দশা সই। টিকে থাকা কঠিন। তাই অস্তিত্বের প্রয়োজনে মিলনের কবুলিয়ত। ধনীর লোকসান হলো না, সমৃদ্ধি আরও বাড়লো। গরিবও বেঁচে গেল। উভয়ে মিলে সুখী সংসার। ধনেধান্যে পরিসর আরও বাড়লো। মন্দ কী? কিন্তু, নাতিখাতিতে বেলা যেতে যেতে আরেক গোলমাল। দেশি ব্যাংকে আস্থা কমতে কমতে তলানির দিকে । চান্সটা পেয়ে গেল বিদেশি ব্যাংকগুলো। ভাবলক্ষণ বুঝে বুঝদার আমানতকারীরা আরও আগে থেকেই বিদেশি ব্যাংকে তাদের অর্থ স্থানান্তরে মনোযোগী। আমানতের ওপর তারা লাভ বা সুদ কম দেয়। এরপরও আস্থা বলে কথা। প্রায় সবক’টি বিদেশি ব্যাংকই রেকর্ড মুনাফা করে চলছে। এসব ব্যাংক চলতি বছরও ভালো ব্যবসা করে চলছে।
ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রেকর্ড ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে এর আগে কোনো ব্যাংকই এ পরিমাণ নিট মুনাফা করতে পারেনি। সামনের দিনগুলোতে তারা লক্ষণ আরও ভালো দেখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিদেশি ৯টি ব্যাংক। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এইচএসবিসির ব্যবসা ও কার্যক্রমই বেশি বিস্তৃত। এছাড়া শ্রীলংকার কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, যুক্তরাষ্ট্রের সিটিব্যাংক এনএ, দক্ষিণ কোরিয়ার উরি ব্যাংক ও ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ারও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কার্যক্রম রয়েছে। এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে পাকিস্তানভিত্তিক ব্যাংক আল ফালাহ্ ও হাবিব ব্যাংক। সুযোগ থাকলে তা না নেয়া বা অগ্রাহ্য করার মতো ঈমানদার বাংলাদেশ কেন বিশ্বের কোথাও নেই। বিদেশি ব্যাংকগুলো এখানে চ্যারিটি করতে আসেনি। সদকায়ে জারিয়া দিতেও আসেনি।
এ রকম সময়েই আবার হ্যাকিংয়ের খবর। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ভারতীয় হ্যাকাররা কয়েক বিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে গেছে বলে খবর দিয়েছে দেশটির গণমাধ্যমই। এতে বলা হয়, উভয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এই ঘটনার গোপন তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। খবরে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশে তো সাংবাদিকরা কেন্দ্রিয় ব্যাংকে নিষিদ্ধই। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ। কোনো সাংবাদিকের সাথে কারো কোনো খাতির আছে কি না, তা পরখে রাখা হচ্ছে। আরও ইন্টারেসিটং বিষয় হচ্ছে, হ্যাকিংয়ের খবরটি বাজারজাত হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রের দপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তির সুবাদে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, একটি ভারতীয় সংবাদপত্র নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হওয়ার খবর প্রকাশ করেছে। সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, এটি ভুল সংবাদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, রিজার্ভ চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি। খবরটি মিথ্যা হলে ভারতীয় ওই পত্রিকা এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ভারতীয় আদালতে বিচার চাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তিনজন কর্মকর্তার উদ্বৃতি দেয়া হয়েছে এরও বিহিত হওয়া দরকার। কিন্তু এ বিষয়ক কোনো খবর নেই।
এর আগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট–ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ভুয়া বার্তার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের নিউ ইয়র্ক শাখায় রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে হ্যাকাররা। চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় চলে যায় দুই কোটি ডলার। পরে শ্রীলঙ্কা থেকে সেই অর্থ অবশ্য উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক হয়ে দেশটির বিভিন্ন ক্যাসিনোয় ঢুকে যায়। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনও ফেরত পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বর্তমানে মামলা চলছে। তা হলে কী দাঁড়ালো বিষয়টা। দাঁড়ানোর খবর স্পষ্ট না হলেও হেলে পড়া-নুয়ে পড়ার খবর কিন্তু বেশির চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: