টাকায় সাদা সাদা, কালা কালা

নির্ধারিত ৬ জুন বাজেট এসেছে। অথবা সরকার বাজেট কে সংসদে এনে উপস্থাপন করেছে। দিনটিতে ধার্য তারিখে আলোচিত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে আসেননি। সরকারও পারেনি তাকে হাজির করতে। দুদক পারেনি তাকে অগাধ কালো টাকা নিয়ে দুচারটা কথা জিজ্ঞাস করতে। তার টাকাগুলো কালো কেন? তিনি তো কালো নন, বেশ সাদা-ফর্সা ফকফকা মানুষ।
মানষের সাদা-কালো-শ্যামলা-তামাটেসহ নানা রং আছে। টাকার সাদা-কালো রং নেই। অর্থনীতির মানদণ্ডে অপ্রদর্শিত আয়কে কালো টাকা বলা হয়। কিংবা যেসব আয়ের উৎস আইনসঙ্গত নয় সেগুলো কালো টাকা। এই কালো টাকা এবারের বাজেটেও বেশ প্রাসঙ্গিক। সরকার প্রতি বছরই কালো টাকা সাদা বানানোর হরেক সুবিধা দিয়ে থাকে। এবারের দেয়া সুবিধাটি বেশ ইন্টারেস্টিং। সৎ পথে আয়ের ওপর সর্বোচ্চ করহার ধরা হয়েছে ৩০ শতাংশ। আর অসৎ পথে আয় করা কালো টাকা সাদা করতে মাত্র ১৫ শতাংশ। সরকার বা রাষ্ট্রের দর্শনট কী চমৎকার না? পরিবেশটাও সুন্দর। তবে কিছুটা হৈচৈ আছে।
আরো কথাও আছে। যারা ৩০% কর দিয়ে এসেসমেন্ট করবে, তাদের ফাইল অডিট হতে পারে। অথচ এই কথিত ১৫% করদাতাদের মি: ক্লিন সনদ দেয়া হবে। সমালোচকরা বলছেন, এ তরিকায় প্রকারান্তরে দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে কেবল বৈধতাই দেয়া হলো না, উৎসাহিতও করা হলো। আবার ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে সাদা নয়, কালো টাকাই বেশি ভালো। ভালোর চেয়েও ভালো। কারো কাছে হকহালালি (৩+১+৪+৫)=১৩ লাখের বেশি টাকা থাকলে কালো বলে চালিয়ে দিলে লাভ হবে। খামোখা বেশি টাকা ট্যাক্স দেয়া লাগবে না।
অপ্রদর্শিত আয়টুকু কর দিয়ে বৈধ করার পর সেটি তো তার বৈধ আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। এখানেও একটু গোঁজামিলের কায়কারবার আছে। তার করযোগ্য আয় কোনটি ধরা হবে? মূল আয় না কালো থেকে সাদা করা আয়? নাকি কেবল মূল আয়! আলোচিত বেনজীর তো এই চান্স নিতেই পারেন। আরো অনেকেই নেবেন। এছাড়া কালো টাকা জন্মের আগে কনডম ব্যবহার করবে না জন্মের পর পেছন পেছন দৌড়াবে- তা যার যার ব্যাপার। এছাড়া, কালো টাকা দিয়ে জমি বা ফ্ল্যাট কিনলে টাকাটা বৈধ হয়ে যাবে। তার মানে যিনি ১০০ কোটি টাকা কালো আয় করেছেন তিনি ১৫ কোটি আয়কর দিয়ে বাকি ৮৫ কোটি সাদা আয় হয়ে যাবে? তা হলে সাদা করা বা সাদা থাকারই বা দরকার কী? আমাদের এমপি আনারকে হত্যা করে খুনিরা যে পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছে বলে প্রচারিত সেই টাকাও কালো। চাঁদাবাজি ,খুন, লুণ্ঠন ,ডাকাতি, চোরাকারবারী, পর্নোগ্রাফি, পতিতাবৃত্তির আয় নিশ্চয়ই ঘোষণা দেয়া যায় না। তারাও একটা সহানুভূতি পেল।
বছর ঘুরে যেমন বছর আসে, শত সংকটের মধ্যেও তেমনি প্রতিবছরই বাজেট প্রণয়ন করতে হয়। আগামী বছরের আশার কথা শোনাতে হয় অর্থমন্ত্রীদের। গত বাজেটে বলা হয়েছিল স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নের কথা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল তার নাম ছিল ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। স্মার্ট শব্দটি এবারও আছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’।এই প্রতিশ্রুতি জানিয়ে ৬ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন যার যার মতো সাদা-কালো রংবেংয়ের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পালা। যার যেমনে পোষায়।
প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় বাজেট বড় হয়, এবারও বেড়েছে। ট্যাক্সের বোঝা, ধনীদের সম্পদ বাড়ে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ, আমলা প্রশাসনখাতে বরাদ্দ সবই বাড়বাড়ন্ত। আর দ্রব্যমূল্য? তা তো সারাবিশ্বেই। আমাদেরটা একটু নজিরবিহীন বা বেনজির। আমাদের তো আরো কতো কিছুই নজিরবিহীন। চারদিকে কেবল স্মার্টনেস। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট অর্থনীতি। সেখানেই স্মার্ট আলাদিন, স্মার্ট চেরাগ। সঙ্গে চল্লিশ চোর। আলাদিন চরিত্রটির পেছনে কাহিনী বেশ ইন্টারেস্টিং। আলাদিনের জাদুর চেরাগের গল্পটির প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৭১২ সালে ফরাসি পণ্ডিত অঁতোয়াগ্যাঁলোর প্রকাশিত আরব্য রজনীর অনুবাদে। তার প্রকাশিত অধিকাংশ গল্পই মূল আরবি পাণ্ডুলিপি থেকে অনুবাদকৃত। আলাদিনের যাদুগরি চেরাগের গল্পরস ছাড়িয়ে বাংলাদেশে বাস্তবে বাম্পার ফলন। আলীবাবা ৪০ চোরও এখানে বড় বাস্তব। এটি আরবি ভাষার একটি লোককাহিনী। অ্যারাবিয়ান নাইটস গল্পগুলির মধ্যে একটি হিসাবে, এটি সারাবিশ্বের অনেক মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং সঞ্চালিত হয়েছে, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। সেই শিশুপাঠ দেশে ক্রমেই বড়দেরও সাদা-কালো পাঠ পঠন?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/এমএফআর
মন্তব্য করুন: