• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

বাংলার পাখপাখালির কলকাকলিতে বেঁচে থাকবেন ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার

আশিকুর রহমান সমী

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ফন্ট সাইজ
বাংলার পাখপাখালির কলকাকলিতে বেঁচে থাকবেন ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার

ফ্রান্সের বিখ্যাত University of Bordeaux এ পাখির উপর পিএইচডিরত বাঙালি ছাত্রটির সুপারভাইজর তার ছাত্রের মাঠ পর্যায়ের পরিশ্রম, অধ্যবসায়, দিন-রাত এক করে কাজ করা, প্রচণ্ড বরফপাতের সময়ও একনিষ্ঠভাবে কাজ করা দেখে বলেছিলেন, 'তুমি যেভাবে কাজ করো, একদিন তো বরফের নিচে চাপা পড়ে মরে যাবে'। বাঙালি ছাত্রটি তার পরিশ্রম এর ফসলও পেয়েছিলেন, ডিসটিংকশনসহ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দীন সরকার, বাংলাদেশে নীরবে-নিভৃতে বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সংরক্ষণ করে যাওয়া একজন মানুষ এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী জীববিদ্যার অন্যতম পথিকৃৎ। 

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় যে মানুষগুলো আমাদের পথিকৃৎ, যাদের হাত ধরে আমাদের দেশের প্রাণ-প্রকৃতি, বন্যপ্রাণীর রক্ষা ও সংরক্ষণের কাজের শুরু, বন্যপ্রাণী বিষয়ে যাদের গবেষনার ফলাফল আলোকিত করেছে বাংলাদেশ সহ পুরো পৃথিবীতে তাদের মধ্যে প্রথম কাতারে যার নামটি আসবে, তিনি হলেন প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। ভারতীয় উপমহাদেশ সহ এশিয়ার মধ্যে একজন খ্যাতিমান বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। সারাজীবন নিভৃতে, বন-বনানীর মাঝে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন প্রাণ প্রকৃতির গবেষণায়।

সাল ১৯৩৭। যমুনা, বড়াল, ইছামতি, করতোয়া, ফুলজোড়া নদী, চলনবিল নিয়ে সিরাজগঞ্জের উর্বর ভূমি, আর অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ। এই জেলার কুচিয়ামারা থানার, বড়ঘোনা গ্রামে সরকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। 

ওই যে, কথায় আছে, প্রকৃতি আপন মনে তৈরি করে তার সন্তানকে, প্রস্তুত করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে তার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। নতুন পথ তৈরি করার জন্য, যে পথ অনুসরণ করবে হাজারো পরবর্তী পথিক।

ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আর পাখির প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিলো এই মানুষটির। নিজে সব সময় গাছ লাগাতেন। মায়ের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে কিনতেন নতুন গাছ। ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ পাখির প্রতি। আর স্কুল ছিলো বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। মাঝে ছিলো চলন বিলের অংশ। সাতরে পার হতে হতো ওই বিল। এরপর উল্লাপাড়া মার্চেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে করেন ম্যাট্রিক পাস। ভর্তি হন সরকারি আজিজুল হক কলেজ বগুড়ায়। সেখান থেকে করেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে যোগদান করেন এই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। বন্যপ্রাণী বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশের প্রথম বন্যপ্রাণীবিদ এমিরেটস প্রফেসর ড. কাজী জাকের হোসেন স্যারের পরপরই যে নামটি উঠে আসে তা হলো প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। তিনি নিজে প্রফেসর ড. কাজী জাকের হোসেন স্যারের ছাত্র ছিলেন।

বাংলার জলে-জঙ্গলে, পাহাড়ে, সমুদ্রে সর্বত্রই শুরু হয় ড. সোহরাব উদ্দীন সরকারের বিচরণ। প্রকৃতিকে তিনি জীবনের সবটুকুই দিয়েছিলেন। মাসের পর মাস কাটিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে, সাগরদ্বীপে কখনও বা সুন্দরবনে। 

মানুষটি খেতে ভুলে যেতেন, পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে পিছনে রেখে এক মনে কাজ করে যেতেন। স্বল্পভাষী এই মানুষটি যেকোনে বিষয়ে খুব গভীর ভাবে চিন্তা করতেন। কখনও কখনও মাসের পর মাস তার কোনো খোঁজ মিলতো না, কোথায় আছেন। কোনো অরণ্যে বন্যপ্রাণী গবেষণায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।  

আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটা উন্নত ছিলো না, ছিলো না বন্যপ্রাণীর তথ্য সংগ্রহে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। কিন্তু সোহরাব উদ্দিন সরকারের যা ছিলো, তা হলো কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, বন্যপ্রাণী, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। প্রকৃতিও তাকে সময়ের পরিক্রমায় করে তুলেছেন প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি নন্দিত একজন বন্যপ্রাণীবিদ এবং পরিবেশবিদ হিসেবে।

আন্তর্জাতিক ও দেশি জার্নালে রয়েছে তার শতাধিক গবেষণাপত্র। রয়েছে অগুনিত জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক আর্টিকেল। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী নিয়ে শুরুর দিকে যত প্রকাশনা রয়েছে তার অধিকাংশই এই মানুষটির সৃষ্টি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর পূর্ণাঙ্গ বইও প্রকাশ করেছেন তিনি। রয়েছে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও তাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বই। আর তার হাজারো ছাত্র-ছাত্রী ছড়িয়ে আছেন পুরো পৃথিবীতে, রাখছেন বন্যপ্রাণী বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রাণীর সংগ্রহশালাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে অবস্থিত। এই সংগ্রহশালাকে প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দীন সরকার করেছেন সমৃদ্ধ। 
প্রফেসর ড কাজী জাকের হোসেন এর সাথে বাংলাদেশে ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটি এবং বাংলাদেশ বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী গবেষণায় সর্বোচ্চ সম্মাননা, বঙ্গবন্ধু এওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন এ ভূষিত হন।

৮৫ বছর বয়সে গত ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিদায় নিয়েছেন এই পৃথিবী থেকে। কালের নিয়ম পাল্টানোর সাধ্য কারো নেই। নশ্বর পৃথিবীতে আমাদের সকালের জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের পরেও মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকেন তার আপন কর্মে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী গবেষণায়  Sarkar et al. বা Sarkar and Sarkar নামটি বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। বাঁচিয়ে রাখবে এই কীর্তিমানকে। 

পৃথিবীর সব থেকে শুদ্ধতম আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা হলো মায়ের ভালোবাসা। আর আমাদের এই মায়াবী ধরিত্রীর, সুন্দর প্রকৃতি মাতৃ-সমতুল্য। প্রকৃতির আছে আপন নিয়মে চলার গতি। আর এই প্রকৃতি মায়ের প্রতি ভালোবাসা হয়তো পৃথিবীর ওই শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন। প্রকৃতিকে ভালোবেসে কেউ কখনও খালি হাতে ফেরে না। প্রকৃতি আপন মনে ডালি সাজিয়ে বরণ করে নেয় তার মানব সন্তানদের। আর ওই মানব সন্তানেরা তাদের কর্মে, কৃতিত্বে, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা ভালোবাসায় পৃথিবীতে হয়ে থাকেন বরেণ্য, চির স্বরণীয়, শ্রদ্ধেও। পাখির কলকাকলীতে, বনের সবুজের মায়া বলে যাবে প্রাণ, প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণীকে ভালোবেসে, নিজের সবটুকু উজাড় করে নিরলস ভাবে গবেষণা কাজ করে যাওয়া প্রফেসর ড. সোহরাব উদ্দিন সরকার এর কথা।

লেখক: আশিকুর রহমান সমী, বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক

বিভি/টিটি

মন্তব্য করুন: