প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ ও করণীয়
করোনা পরবর্তীকালে দিন দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে আমি যা বাস্তবে উপলব্ধি করছি এবং আমার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক শিক্ষককে এর কারণ জানতে প্রশ্ন করে উত্তর যা পেলাম- ক্যাচমেন্ট ব্যাঙের ছাতার মতো অনুমতিবিহীন কিন্ডারগার্টেন ও পাড়ায় পাড়ায় মাদ্রাসা গড়ে উঠা। সত্যি বলতে আমি বৰ্তমানে যে স্কুলে কর্মরত আছি সেখানে ২০০৯ সালে যোগদান করি। তখন আমার স্কুলের পাশে কোনো মাদ্রাসা ছিল না, ছিল না কোনো কিন্ডারগার্টেন। শিক্ষার্থী ছিল ৬১০ জন। এক বছর পর এখানে বিদ্যালয়ের ২০০ গজের মধ্যে একটি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করা হয়, কিছু শিক্ষার্থী যারা পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি তাদের পুনরাবৃত্তি রাখায় ওরা চলে যায় কিন্ডারগার্টেনে। তার প্রায় এক বছর পর আরও একটি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা পায় আমার বিদ্যালয়ের ৩০০ গজের মধ্যে। আরও কিছু শিক্ষার্থী ওই একই কারণে চলে যায় ওখানে। ওই বছরেই আমার ক্যাচমেন্ট এলাকার ভিতর পাশ্ববর্তী গ্রামে একটি নুরানী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিছু শিক্ষার্থী ওই মাদ্রাসায় চলে যায়। অভিভাবক যখন টিসি নিতে আসেন, প্রশ্ন করলে তারা জানান, আপনাদের বিদ্যালয়ে পড়ালে সকালের মক্তব পড়া বাদ হয়ে যায়। তাছাড়া পরকালের কথাও তো ভাবতে হবে। তার এক বছর পর বাজার সংলগ্ন ৩৫০ গজের ভিতর নদীর এপার ও ওপার পাল্লা দিয়ে দুটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আরও কিছু শিক্ষার্থী কমতে শুরু হয়। আমার বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বে দেড় কিলোমিটারের মাথায় এক বাড়িতে আমার কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে রুপসী বাংলা নামে আরও একটি শিখন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের প্রশ্ন করলে বলা হয় আমরা সরকারি বই পাইছি কয়দিন পর সরকারি হয়ে যাবো। মোট কথা একটি বিদ্যালয়ের পাশে ২টি কিন্ডারগার্টেন, ৩টি মাদ্রাসা ও ১টি শিখন স্কুল হলে শিক্ষার্থী তো কমবেই। পাশ্ববর্তী বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকদের জবাব আশেপাশে অনুমতিবিহীন মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেন হওয়ার কারণে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। আমি একজন অভিভাবককে জানতে চাইলাম আপনার সন্তানকে মাদ্রাসায় কেন নিলেন? উত্তরে তিনি জানালেন, স্যার আপনাদের স্কুলে সকাল ৯টা থেকে বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত ক্লাস করানো হয়। আমরা সকালের মক্তবের পড়া পড়াতে পারছি না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ নিম্নরূপ:
১। ২০১৯-২০ করোনাকালীণ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার প্রবণতা বেশি হয়েছে। তখন আমাদের বিদ্যালয় বন্ধ ছিল কিন্তু মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেন চালু ছিল। অভিভাবক তাদের সন্তানদের সকালের দুষ্টামি কিংবা পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা বন্ধে তখন তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ও কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করান। আর একবার ভর্তি হলে ওই মাদ্রাসা/কিন্ডার গার্টেন তাদের ছাড়তে চান না।
২। সকালে মক্তবের আরবী পড়া মিস হওয়া।
৩। পাড়ায় পাড়ায় অনুমতি বিহীন ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডার গার্টেন ও নুরানী মাদ্রাসা গড়ে ওঠা ও তাদের তদারকি না থাকা।
৪। ধর্মীয় কু-সংস্কার বা মিথ্যা তথ্য প্রদান। কিছু কিছু মাদ্রাসার শিক্ষক অভিভাবককে এমনভাবে বুঝান যে, মাদ্রাসায় পড়ালে ইহকাল পরকাল দুটোই পাওয়া যাবে খুব সহজে।
৫। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘণ্টা। সকাল ৯ টায় স্কুলে আসার কারণে অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে সকালের খাবার দিতে পারেন না। আবার দীর্ঘক্ষণ শিক্ষার্থী শ্রেণি কক্ষে বসে থাকতে চায় না।
৬। বিদ্যালয়গুলো সোয়া চারটায় ছুটি হয় তাই শিক্ষার্থীরা বিকেলে খেলাধুলার সুযোগ পায় না পক্ষান্তরে কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসায় দুপুর ১২ টা কিংবা ০১ টার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও খেলাধুলার সুযোগ পায় তাই অভিভাবক তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ও কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি
করান।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাওয়া রোধে আমাদের করণীয়:
১। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্কুল যাতে একই সাথে বন্ধ থাকে তা কর্তৃপক্ষের সুনজর রাখা ও প্রয়োজনীয়
২। বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম দেশ। বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান। অভিভাবকদের মক্তবে আরবী পড়াতে ইচ্ছুক। তাই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৩। যত্রতত্র অনুমতিবিহীন ব্যাঙের ছাতার মতো যাতে কোনো কিন্ডারগার্টেন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এলাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠে তার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ও মনিটরিং জোড়দার করা।
৪। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে যাতে কোনো রকম মিথ্যে তথ্য প্রদান না করে তার সুষ্ঠু মনিটরিং করা।
৫। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখন ঘণ্টা কমানো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতকরা ৬০ শতাংশ মহিলা শিক্ষক আছেন যারা বাড়ির কাজ সামলিয়ে রান্না বান্না সেড়ে বিদ্যালয়ে আসেন। তাই বিদ্যালয় খোলার সময় সকাল ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত করা। একজন শিক্ষার্থী সোয়া চারটায় ছুটি হলে বাসায় গিয়ে বিকালে খেলাধুলার সুযোগ পায় না। তাই শারীরিক বিকাশ সাধনে শিক্ষার্থীকে বিকালে খেলাধুলা চর্চার সুযোগ দিতে বিদ্যালয়ের ছুটি ৩টায় হওয়া উচিত।
৬। শিক্ষক হিসেবে আমাদের করণীয় হবে, নিয়মিত হোমভিজিট জোরদার করা, শিক্ষক অভিভাবকদের সুসম্পর্ক তৈরি করা, ওঠান বৈঠক, মা সমাবেশ, বিভিন্ন দিবসে র্যালি করা, অভিভাবকদের কাউন্সিলিং ও বিদ্যালয়ের সকল প্রোগ্রামে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো। বার্ষিক শিক্ষা সফরের আয়োজন করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় করা ও বিদ্যালয়ে আনন্দনঘন পরিবেশ তৈরি করা।
৭। বেস্ট স্টুডেন্ট ও বেস্ট অভিভাবক নির্বাচন করে তাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা।
লেখক: তাবারক হোসেন, প্রধান শিক্ষক, ৮নং চর সেনসাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: