• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ১২ মে ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

কী ঘটছে কাঁচা বাজারে, লাগাম টানবে কে?

আহমেদ শাহেদ

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ১১ অক্টোবর ২০২৪

ফন্ট সাইজ
কী ঘটছে কাঁচা বাজারে, লাগাম টানবে কে?

বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক চিত্রটি বেশ উদ্বেগজনক। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে কাঁচা বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে প্রতিনিয়তই চরম সংকটে পড়তে হচ্ছে। বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই যা হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে; সবকিছুর দাম বেড়েই চলেছে। এমন অবস্থায় সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কৃত্রিম সংকট প্রতিরোধ করা। 

মূল্যবৃদ্ধি: কী ঘটছে কাঁচা বাজারে?
সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে কাঁচামাল, মাছ-মাংস, এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একটি বড় ধাক্কা হিসেবে কাজ করছে। সরবরাহে সংকট না থাকলেও, বেশিরভাগ পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, যা ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা অনেকাংশে কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে সবজি, ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এতোটাই বেড়ে গেছে যে, অনেক পরিবার দৈনন্দিন বাজেটের সাথে তাল মেলাতে পারছে না।

বর্তমানে ১০০ টাকার নিচে তেমন কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। বেগুন, শসা, টমেটো, পটল ইত্যাদির দাম প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকার মধ্যে। এমনকি কাঁচামরিচ এবং পেঁয়াজের মতো মসলাজাত পণ্যের দামও অনেক বেড়েছে। মাসে মাসে বাজারে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা আসায়, মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচের দিকে চলে যাচ্ছে।

মূল্যবৃদ্ধির পেছনের কারণসমূহ
বাজারে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সরবরাহ চেইনের দুর্বলতা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফা লিপ্সা। যদিও দেশে কোনো সরবরাহ ঘাটতি নেই, তথাপি, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দালালরা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তারা।

বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা খুবই শক্তিশালী। কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে তারা বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে। এর ফলে কৃষক যেমন ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি ভোক্তাদেরও পণ্য কিনতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ না করা পর্যন্ত বাজারের এই অবস্থা চলতেই থাকবে।

অন্যদিকে, পরিবহন খরচ বৃদ্ধিও মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একটি বড় কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে, যার প্রভাব বাজারে পড়েছে। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে পণ্য আনার খরচ এতোটাই বেড়ে গেছে যে, বাজারে পণ্যের দাম কমানোর কোনো সুযোগ থাকছে না।

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবও একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে, খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলে। তেল, চিনি, চাল, ডালের মতো পণ্য আমদানি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের মূল্য বাড়লে, দেশের বাজারেও তার প্রভাব পড়ে। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনে সমস্যার কারণে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে, যা আমাদের অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাব এবং সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মহামারির প্রভাবে বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অনেকাংশেই বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে দেশের আমদানিকারকরা সেই খরচ ভোক্তাদের উপর চাপিয়ে দেন, যার কারণে আমাদের বাজারেও পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

সরকারের উদ্যোগ এবং ব্যর্থতা
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং নীতিনির্ধারকেরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না, যা বাজারের বর্তমান অস্থিরতার অন্যতম কারণ। টিসিবি (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) মাঝে মাঝে নিত্যপণ্য বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করে, কিন্তু এটি শুধু বড় শহরের সীমিতসংখ্যক জনগণের জন্য কার্যকর। এই উদ্যোগগুলো গ্রামাঞ্চলে বা তুলনামূলকভাবে কম জনবহুল এলাকায় পৌঁছাতে পারে না। এছাড়া, অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের নিয়মকানুনকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

সরকারকে বাজারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা, টিসিবি'র কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত করা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এছাড়া, কৃষকদের জন্য সঠিক দামে পণ্য বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া দরকার, যাতে তারা ন্যায্যমূল্য পায় এবং পণ্যের সরবরাহও ঠিক থাকে।

নাগরিকদের ভূমিকা
এই বাজার অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে নাগরিকদেরও সচেতন ভূমিকা পালন করা জরুরি। ভোক্তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পণ্য না কিনে বাজারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। তাছাড়া, ভোক্তারা একত্রিতভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারেন। কোনো বিশেষ পণ্যের মূল্য বাড়লে, সেই পণ্যটি কেনার ক্ষেত্রে কিছুদিন বিরত থাকাও একটি কার্যকরী পন্থা হতে পারে, কারণ এতে করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের প্রভাব কমে যাবে।

নাগরিকরা যদি সচেতন হয়, তবে বাজার পরিস্থিতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বিশেষ করে, স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কেনা একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। এতে করে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে এবং কৃষকরাও ন্যায্যমূল্য পাবে। এছাড়া, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রেখে নাগরিকদের পক্ষ থেকে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

কৃত্রিম সংকট মোকাবেলায় সম্ভাব্য পন্থা
বাজারে কৃত্রিম সংকট মোকাবেলায় বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখলে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, দেশের কৃষকদের জন্য উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে পারে।

তৃতীয়ত, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে এবং যেখানে মূল্যবৃদ্ধি কৃত্রিমভাবে ঘটানো হচ্ছে, সেই জায়গায় সরাসরি পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া, টিসিবি'র মতো সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা দরকার, যাতে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ কম মূল্যে পণ্য কিনতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাজার পরিস্থিতির এই অস্থিরতার মধ্যেও কিছু সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থা শক্তিশালী হতে পারে। স্থানীয় কৃষকদের সহায়তা বাড়িয়ে, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য আইনের প্রয়োগ আরও জোরালো করতে হবে।

সর্বোপরি, নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আয়-ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। ন্যায্য মজুরি এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই কাঁচা বাজারের সংকট নিরসন করা সম্ভব।

উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, বাজার পরিস্থিতি এখন এক জটিল সমস্যার মধ্যে আছে। সরকারের নীতিনির্ধারক এবং নাগরিকদের একসাথে কাজ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কাঁচা বাজারে লাগাম টেনে ধরা সময়ের দাবী। সঠিক উদ্যোগ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে বাজার স্থিতিশীল রাখা অত্যন্ত জরুরি, কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না রাখলে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যাবে। অতএব, বাজারের অস্থিরতা রোধে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে একটি সুষম অর্থনৈতিক কাঠামোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন: