• NEWS PORTAL

  • রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

মুরাদ হাসানের পরিণতি ও আমাদের শিক্ষা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশিত: ১৭:২৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৭:২৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
মুরাদ হাসানের পরিণতি ও আমাদের শিক্ষা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অত্যন্ত সজ্জন শিক্ষক ছিলেন। মৃদুভাষী এবং স্মিতহাসি লেগেই থাকতো তাঁর মুখে। সম্ভবত আমাদের তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ চলছিলো। একদিন তিনি ক্লাসে আসার আাগে আমাদের সহপাঠিদের একজন পুরো ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে অমার্জিত একটি বাক্য লিখেছিলো এবং নজরুল স্যার ক্লাসে চলে আসায় সে আর বাক্যটি মুছে ফেলতে পারেনি। স্যার এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে ডাস্টার নিয়ে বাক্যটি মুছে ফেলেন এবং এরপর একবাক্যে যা বলেন, তার মর্মার্থ ছিলো, খুব নিচু স্তরে জন্মলাভকারীর পক্ষেই এই ধরনের কথাবার্তা লেখা ও উচ্চারণ করা সম্ভব। 

সদ্য সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের গত দুই-তিন মাসের বিশ্রম্ভালাপ শুনে নজরুল স্যারের কথাটি বারবার মনে পড়েছে। হতে পারে তিনি ভালো পরিবারের সন্তান, কিন্তু ভালো শিক্ষা লাভ করেননি। না পারিবারিক, না প্রাতিষ্ঠানিক, না রাজনৈতিক। জাতীয় সংসদে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের যে শিক্ষা তা তাঁর অসংসদীয় শব্দ প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। পরিবেশগত ও অবস্থানগত ভব্যতাও তাঁকে শিক্ষিত করে তুলতে পারেনি। একটি চেয়ার তাঁকে অশিষ্ট, দুর্বিনীত করে তুলেছিলো। বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কিশোরী নাতনি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেত্রীদের সম্পর্কে তাঁর অশালীন মন্তব্য, চলচ্চিত্রের একজন নায়িকার সংগে টেলিফোনে তাঁর সংলাপ অশ্রাব্য হলেও আমিসহ অনেককে তা শুনতে হয়েছে। এমনকি একটি অনুষ্ঠানে, ভিডিওতে দেখে বিয়ের অনুষ্ঠান বলেই মনে হয়েছে, সেখানে মুরাদ হাসানকে কাদের মা’দের তিনি কী করবেন চিৎকার করে বলতে বলতে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে। একজন ব্যক্তির নৈতিক মান কতোটা নিচু হলে এই ধরনের শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব; তা বুঝতে জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের চোখের অন্তরালে তিনি কী কী করেছেন, তা একমাত্র আলিমুল গায়েব জানেন। তবে দৃশ্যতঃ যা বলেছেন এবং করেছেন, তাতে তিনি নৈতিক স্খলনের দোষে দোষী। 

ডা. মুরাদ হাসান

বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এটিই প্রথমবার কোনো মন্ত্রীকে নৈতিক স্খলনজনিত কারণে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা ঘটলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি কাজ করেছেন। আশির দশকের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের সরকারের সময় একজন অতি ক্ষমতাবান মন্ত্রী, যিনি খ্যাতনামা চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে একজন নারী রোগী অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগ গুরুতর ছিলো, কিন্তু মন্ত্রী বহাল তবিয়তে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অসংখ্য অভিযোগ ছিলো, তিনি সেসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে তাঁর অপকর্ম চালিয়ে যেতে দ্বিধা করেননি। 

উন্নত দেশগুলোতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নৈতিক স্খলন সহ্য করা হয় না। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। অথবা দ্রুত তাঁকে অপসারণ করা হয়। গত আগস্টেই নিউইয়র্কের জনপ্রিয় গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমোকে নৈতিক স্খলনের অপরাধে অপসারণ করা হয়েছে। এন্ড্রু’র কারণে ক্যুমো পরিবারের দু’শো’ বছরের রাজনৈতিক ঐতিহ্য কলঙ্কিত হয়েছে। তাঁর পিতা মারিও ক্যুমোও একাধিক মেয়াদে নিউইয়র্কের গভর্নর ছিলেন। ডজনখানেক নারী এন্ড্রু ক্যুমো’র বিরুদ্ধে আপত্তিকর যৌন আচরণের অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগকারীরা এন্ড্রু’র কোনো আচরণ প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিওনস্কি’র পর্যায়ে গিয়েছিলো মর্মে অভিযোগ না করলেও এন্ড্রু তাঁদের সংগে যা করেছিলেন, তা আমেরিকান শালীনতা অনুযায়ী আপত্তিকর যৌন আচরণই ছিলো। 

এন্ড্রু ক্যুমো

এন্ড্রু তদন্ত কমিটির শুনানিতে বলেছেন, তিনি যা করেছেন তা ব্যক্তিগত আচরিত অভ্যাস অনুযায়ীই করেছেন, যা দোষণীয় পর্যায়ে যেতে পারে বলে তিনি ভাবেননি। যেমন- করমর্দনের সময় অভিযোগকারী নারীদের হাতে জোরে চাপ দেওয়া, কাঁধে বা কোমরে হাত রাখা এবং আলিঙ্গনের সময় গালে ঠোঁট স্পর্শ করা। সম্মতি ছাড়া এসব কর্ম আইনত শাস্তিযোগ্য এবং এন্ড্রু ক্যুমো যথাবিহিত শাস্তি লাভ করেছেন। আমেরিকান বলে নয়, সব সংস্কৃতিতেই অভ্যাসের দাস এমন লোকজনের অস্তিত্ব রয়েছে। 

মনিকা লিউনস্কি’র সংগে বিল ক্লিনটনের আচরণ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছিলো। ইংরেজি ভাষায় যাকে ‘পেনিট্রেশন’ বা সোজা বাংলায় ‘যৌন সঙ্গম’ না হলেও উভয়ের মধ্যে যা যা হয়েছিলো, তা পেনিট্রেশনের চেয়েও ভয়াবহ ছিলো। দিনের পর দিন তাঁরা পেনিট্রেশন ছাড়া সব যৌনকর্ম করেছেন। গভর্নর অল্পতেও পার পাননি, কারণ অভিযোগকারীরা তাঁদের সম্মতিহীন যৌন আচরণের অভিযোগ করেছেন। ক্লিনটন ও লিউনস্কি যা করেছেন, তা দু’জনের সম্মতিতে। দু’জনই তদন্তকারীদের কাছে তা স্বীকার করেছেন। ক্লিনটন জাতির কাছে, তাঁর স্ত্রী হিলারি, কন্যা চেলসিয়া, রাজনৈতক সহকর্মীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, হিলারি তাঁকে ক্ষমা করেছেন। তা সত্ত্বেও এক ধরনের জোড়াতালির মধ্য দিয়ে ক্লিনটন অনিবার্য ইমপিচমেন্ট থেকে রক্ষা পেয়েছেন।

বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিওনস্কি

আমেরিকান প্রশাসনের দায়িত্বে যারা থাকেন, তাঁদের নৈতিকতার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার চেষ্টা নিরন্তর। সিনিয়র বুশ ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে যখন তাঁর প্রশাসনের লোকজন বাছাই করার পর্যায়ে ডিফেন্স সেক্রেটারি হিসেবে প্রস্তাব করেন টেক্সাসের জন জি টাওয়ারের নাম। প্রেসিডেন্ট কারও নাম প্রস্তাব করলেও সিনেট তা নিশ্চিত না করলে প্রেসিডেন্ট তাঁর পছন্দনীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারেন না। সিনেটের আপত্তির কারণ জন টাওয়ার মদ্যপায়ী এবং বহু নারীতে আসক্ত। তাঁর মতো একজনকে প্রশাসনে নেওয়া যায় না। বুশ যতো বলেন, এসব ছোটখাটো মানবিক দুর্বলতা। সিনেট কিছুতেই অনুমোদন দেবে না। বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন এবিসি টেলিভিশনের স্যাম ডোনাল্ডসন জন টাওয়ারের একটি সাক্ষাৎকার নেন। টাওয়ার বলেন, ডিফেন্স সেক্রেটারির দায়িত্ব পেলে তিনি মদ্যপান ছেড়ে দেবেন। তিনি আরও বলেন, “কিন্তু নারীসঙ্গ লাভ কি অন্যায়? আমি তিন বছর যাবত বিপত্মীক। অন্যরা যেভাবে প্রেম করে, ডেটিংয়ে যায়, আমিও যাই। এর মধ্যে অপরাধ কোথায়, স্যাম।” তবু কংগ্রেস তাঁকে অনুমোদন দেয়নি। ডিফেন্স সেক্রেটারি হন ডিক চেনি। 

জন জি টাওয়ার

আমেরিকায় নৈতিকতার মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে শুধু শীর্ষ পদগুলোতেই নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। অনেক কংগ্রেসম্যানের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারীদের পক্ষ থেকে সম্মতি বহির্ভূত যৌন আচরণের অভিযোগ উঠেছে এবং হাউস এথিকস কমিটির শুনানি ও এফবিআই-এর তদন্ত এড়াতে তাঁরা কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেছেন। 

বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের অভিযোগ ছাড়াও কোনো নারীকে যৌন উত্যক্তকর টেক্সট মেসেজ পাঠানো, ই-মেইল, টুইটারে আপত্তিকর ছবি পাঠানোর মতো অভিযোগেও পদত্যাগ করার, দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বহু ঘটনা রয়েছে। 

২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত যেসব কংগ্রেসম্যানকে নৈতিক স্খলনের অভিযোগে পদত্যাগ করতে হয়েছে, তারা হলেন: নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান এরিক মাসা, ইন্ডিয়ানা’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মার্ক শোডার, নিউইয়র্কের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ক্রিস লী, নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান এন্থনি ওয়েনার, টেনেসি’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান স্কট ডেস-জার্লাইস, অরিগন-এর ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান ডেভিড উ, লুইজিয়ানা’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ভ্যান্স ম্যাকঅ্যালিস্টার, টেক্সাস-এর রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ব্লেক ফ্যারেনথোল্ড, ইলিনয়-এর রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সাবেক স্পিকার) ডেনিস হ্যাসটার্ট, পেনসিলভেনিয়া’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান টিম মার্ফি, মিনেসোটা’র ডেমোক্র্যাট সিনেটর অ্যাল ফ্রাংকেন, টেক্সাস-এর রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জো বার্টন, মিশিগান-এর ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান জন কনইয়ার জুনিয়র, অ্যারিজোনা’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ট্রেন্ট ফ্রাংক, পেনসিলভেনিয়া’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান প্যাট মাহিন, ওহাইয়ো’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জিম জর্ডান, ক্যালিফোর্নিয়া’র কংগ্রেসম্যান ক্যাটি হিল, ফ্লোরিডা’র রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ম্যাট গায়েটজ। 

মানুষ ইন্দ্রিয় তাড়নার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু মাত্রা ও পরিমিতি বোধ, শিষ্টাচার বলেও কিছু শব্দ আছে। কোড অব এথিকস আছে। কাকে কোথায় কী করতে হবে, কে কী বলতে পারে সেজন্য নৈতিকতার মানদণ্ড রয়েছে। সীমা লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান আছে। ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

মুরাদ হাসানের পরিণতি সবার জন্য শিক্ষণীয় হোক!

লেখকঃ খ্যাতিমান অনুবাদক, লেখক, কবি এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
উপদেষ্টা সম্পাদক, উইকলি বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক।

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2