• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

মা বলেছিলেন, নিজের দেশ ছেড়ে কেউ যায়!

জসিম মল্লিক

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
মা বলেছিলেন, নিজের দেশ ছেড়ে কেউ যায়!

মা একবার বলেছিলেন তুমি কেনো বিদেশে গেলা! ওখানে কি আছে! নিজের দেশ ছেড়ে কেউ যায়! মায়ের কথাগুলো খুউব মনে বাজে আমার। তখন আমি দশ বছরের বালক। সেদিন ছিল ১৭ এপ্রিল, দুপুর, ১৯৭১ সাল। অন্যান্য দিনের মতো আমাদের বাড়ির খেলার মাঠে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং করছিল। আমরা ছোটরা প্রতিদিন মহা আগ্রহ নিয়ে সেই ট্রেনিং দেখি। বড়দের ফুট ফরমাশ খাটি। পানি, খাবার এনে দেই। যেনো একটা বিরাট উৎসব। চারিদিকে একটা টেনশন। যে কোনো সময় বরিশাল আক্রমন করতে পারে পাক বাহিনী। আগের দিন বরিশাল বেলপাৰ্কের মাঠে প্রকাশ্যে এক রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা  গুলি করে মেরেছে। তারপর থেকে সবাই নানা কথা বলাবলি করছে। একটা ভয় বিরাজ করছে চারিদিকে টের পাই আমি। ছোট হলেও সেই উৎকন্ঠা আমাকে ছুঁয়ে যায়। হঠাৎ বজ্রনিনাদের মতো মাথার উপর প্রকান্ড শব্দ নিয়ে ফাইটার প্লেন বম্বিং শুরু করে দিল। আমরা দৌড়ে পাশের ব্যারে(তখনও বাংকার কি জানতাম না) লুকালাম। মনে হয়েছিল আজ আমার শেষ দিন। যুদ্ধে নাকি কেউ বেঁচে থাকে না। তখন খুউব মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মাকে কি আর দেখব না! হঠাৎ দেখি মা ব্যারের মধ্যে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আছে মা বলেছিলেন কোনো ভয় নাই। আমাদের শেখ সাব আছেন, মুক্তিরা আছেন। মা লেখাপড়া জানতেন না কিন্তু দেশপ্রেম ছিল প্রবল। যেদিন বললাম আমি ওদেরকে নিয়ে কানাডা চলে যাচ্ছি, মা শুনে নীল হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, নিজের দেশ ছেড়ে কেউ যায়!



দেশ ভাগের পরে অনেক লোক ভারতে চলে যায়। তারা সেখানে ভাল জীবন পেলেও তাদের মধ্যে একটা দু:খবোধ ছিল। ভাবতো তারা কি রিফিউজি? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ সম্পর্কে অনেকদিন পর বাংলাদেশে বেড়াতে এসে একবার লিখেছেন ‘শীতকালে মেঘহীন নক্ষত্র খচিত আকাশ। ছায়াপথের অণু-পরমাণুর মতন আকৃতির সব তারা, যেমন ছোটবেলায় ছাদে শুয়ে দেখেছি। তখন মনে হত, এই বিশাল মহাকাশে আমাদের এই পৃথিবী নামের গ্রহটি একটা বালুকনার মতোও নয়। তার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র। তারই মধ্যে মানুষের সভ্যতা, সেখানে  ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের কল্পনার জগৎ কত সীমাহীন, কালহীন, দিগন্তহীন? এই পৃথিবীরও অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে কত মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে গেছে, খাদ্য, পানীয় ও নিরাপত্তার সন্ধানে মানুষ জন্মস্থান ছেড়ে অজানার সন্ধানে যেতে দ্বিধা করেনি, পাড়ি দিয়েছে আপাতদৃষ্টিতে অকুল সমুদ্র। তা হলে আমার বাবা-কাকারা যে-কোনও কারণেই হোক ফরিদপুর ছেড়ে চলে গেছেন কলকাতায়, তা নিয়ে এত আদিখ্যেতা করারই বা কী আছে? মানুষ তো বাসস্থান বদলাতেই পারে। মাদারিপুরের সেই গ্রামের বাড়ির তুলনায় কলকাতায় আমরা তো তেমন খারাপ অবস্থায় নেই। প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হলেও যে নাগরিক উপভোগ পেয়েছি, তা কি কম আকর্ষনীয়? দেশ কি একটা ধোঁয়াটে আবেগময় ধারণা মাত্র নয়’!

তা সত্বেও বিদেশে থাকলেও আমার মন সবসময় পড়ে থাকে দেশে। তাইতো বারবার ছুটে আসি কি এক মায়ায়, এক আকৰ্ষণে। দেশের বৃষ্টির ঘ্রাণের সাথে অন্য কোনো দেশের তুলনা হয় না। দেশের খাবারের  স্বাদের সাথে অন্য দেশের খাবারের তুলনা নাই। মাঝে মাঝে মনে হয় না পেরেছি বিদেশী হতে না পারছি দেশে থাকতে! বিদেশে যারা থাকে তাদেরকে দেশের মানুষেরা পর করে দেয়। আর নিজের ভাবে না। আত্মীয়রা পৱ কৱে দেয়, বন্ধুরা পৱ কৱে দেয়। দেশের মাটিও যেনো মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্ৰবাসীৱা না ঘরকা না ঘাটকা। সব সময় মনে হয় যখন বরিশালের নির্জন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম তখন নিবিড় ঝিম ঝিম, অনুত্তেজক নৈশব্দ ঘিরে ধরত আমাকে। ঘিরে ধরত ভেজা মাটির গন্ধ। ঘিরে ধরত গাছপালা। মনে হত এরাই আমার বন্ধু। প্রতিটি বৃক্ষ, কীটপতঙ্গ, তৃণভূমি, নদী, পশুপাখি সব আমার বন্ধু। এখন ভাবি টরন্টো শহরের বাস ঘুচিয়ে চলে যাব মামাবাড়ি ঢাপরকাঠির  গ্রামে যেখানে মায়ের সাথে থাকতাম বছর বছর। গরুর গাড়ি, ডোবার গর্ত, পানিতে ভরভরন্ত, খানাখন্দ ভেঙে, কাদা ঘেঁটে হাঁটব, মাটি মাখব, ভাব করব পৃথিবীর সঙ্গে। যেমনটা শিশুকালে ছিলাম। আল পথ দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যাবো। ক্ষেতগুলো ডুবে থাকবে পানিতে, চিনে জোক রক্ত চুষে নেবে, ক্রমে নিবিড় থেকে নিবিড়তর গাঁয়ের মধ্যে চলে যেতে যেতে দু’খানা চোখ রুপমুগ্ধ সম্মোহিত হয়ে খুঁজবে শৈশব। 

বরিশালের পুরনো জায়গাগুলো আবার ঘুরে ঘুরে দেখব। নূরিয়া হাই স্কুল, হাতেম আলী কলেজ, বিএম কলেজ, পাবলিক লাইব্রেরি, অশ্বিনী কুমার টাউন হল, বিবির পুকুর, উদীচি, প্রেসক্লাব, বুকভিলা, দরগা বাড়ি মসজিদ, বর্মন রোড, কাউনিয়া, আমানতগঞ্জ, মেডিক্যাল কলেজ, গোরস্থান, অভিরুচি সিনেমা হল, শশী মিষ্টান্ন ভান্ডার, ঘর বরন, ঘোল দই খাব মিষ্টি মুড়ি দিয়ে, সদর রোড, চকবাজার, ব্রাউন কম্পাউন্ড, কালিবাড়ি, ব্যাপ্টিষ্ট মিশন স্কুল, চৌমাথা, আলেকান্দা, সাগরদী বাজার, আরো কত অলি গলি, বাড়ির আনাচ কানাচ সেসব জায়গার ধুলো মাখব গায়ে। খুব কৈশোরে বরিশাল ছাড়া বাইরের জগত কিছুই জানতাম না। ওখানকার জল-হাওয়া-মাটি আমাকে কিছু বলতে চাইত। আমার বন্ধুর মতো ছিল সব। এখন এতটা বয়সেও এক যুক্তিহীন বাচ্চা ছেলে আমাকে হাত ধরে কেবলই টানে। খুব টানে..।
জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়..
ধুম্র তপ্ত আঁধিৱ কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে
সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে
ছুটে যায় দুটি আঁখি
-কত দূর হায় বাকি!
উধাও অশ্ব বল্গাহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে,
পথে পথে তার বাধা জ’মে যায়,-তবু সে আসে না ফিরে…
 

মন্তব্য করুন: