শবে মেরাজ: সশরীরে ছিল, স্বপ্ন যোগে নয়
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেভাবে এলো

আরবী ‘রজব’ মে’রাজুন নবীর মাস। লাইলাতুল মেরাজ বা মেরাজের রাত, সচরাচর শবে মেরাজ হিসাবে আখ্যায়িত হয়। সব আসমান পেরিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে যাওয়া রাতের সফরই ‘মেরাজ’। কুরআনে যাকে ইসরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত উম্মে হানি (রা.) ঘর থেকে যে সফরের শুরু হয়েছিল। পরে মসজিদে হারাম বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে একে একে সাত আসমান ও সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে রফরফ নামক বিশেষ বাহনে আরশে আজিমে আল্লাহর প্রেমময় সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ এ ঘটনার আলোকপাত করেন এভাবে-“ পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে (মুহাম্মাদ সা.) রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন। যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১)।
২৬শে রজব হযরত উম্মে হানি (রা.) ঘরে ঘুম এবং জাগ্রত অবস্থার মাঝখানে নবীজি আরাম করছিলেন। দুইজন ফেরেশতা এলেন, নবীজিকে উঠালেন। নিয়ে গেলেন বায়তুল্লার হাতিমের অংশে। সেখানে নবীজিকে শোয়ালেন। জিবরাঈল ফেরেশতার হাতের ইশারায় নবীজির বক্ষ উম্মুক্ত হলো। ভেতর থেকে কলব বের করে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে দিলেন।
জমির উপর সবচেয়ে উকৃস্ট জমজমের পানি দিয়ে ধোয়ার পর হেকমত এবং নূর দিয়ে উম্মুক্ত বক্ষ বন্ধ করে দিলেন। জিবরাঈলের হাতের ইশারায় আগের অবস্থা ফিরে পেল শরীর। এর আগে চার বছর বয়সে একবার মাঠের মধ্যে নবীজির দুধ মা হালিমার সন্তানের সামনে নবীজির কলব পরিস্কার করেন রহমতের ফেরেশতারা। তেমনি যৌবনকালের শুরুতে দ্বিতীয়বার ও নুবয়ত লাভের সময় তৃতীয়বার মেরাজ রাত সহ চতুর্থবার বক্ষ বিদীর্ণ করা হয়েছিল।
বায়তুল্লাহ থেকে গাধার চেয়ে একটু বড় খচ্চরের চাইতে ছোট বোরাকের পিঠে নবীজি সওয়ার হলেন। বোরাকের যেখানে দৃস্টি যেত সেখানে কদম ফেলত। দ্রুত গতিতে চলছে। মদীনায় নবীজিকে জিবরাঈল (আ.) নামতে এবং দুই রাকায়াত নামাজ আদায় করতে বললেন। এবং এটাও জানিয়ে দিলেন, এখানে হিযরত করে আসতে হবে। সেখানে নবীজি দুই রাকায়তা নামাজ পড়লেন। কতটুকু যাওয়ার পর জিবরাঈল (আ.) আবারো নবীজিকে নামতে এবং দুই রাকায়তা নামাজ আদায় করতে বললেন। জানিয়ে দিলেন, এটি আপনার পূর্ব পুরুষ ইব্রাহিম (আ.) এর জন্মস্থান।
এরপর মিশর হয়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে যাওয়ার সময় নবীজি জান্নাতের খুশবু পান। নবীজি জিবরাঈলকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের খুশবু । উত্তরে জিবরাঈল বলেন, “কবর থেকে খুশবু আসছে । ফেরাউন ছিল কাফের। তার সময় তার এক বাদি ছিল। তিনি গোপনে মুছা (আ.) এর উপর ঈমান আনেন। মুছাকে নবী ও আল্লাহকে রব মানার কারণে ফেরআউন ক্ষুদ্ধ হন।
বড় কড়াইয়ে তেল উত্তপ্ত করে তাতে ফেলার জন্য দুই কন্যাসহ মহিলাকে ডেকে আনেন। প্রথম সন্তানকে কড়াইয়ে ফেলে হত্যার পর মা ইতস্তত করছিলেন। এমন সময় কোলের দ্বিতীয় সন্তানের জবান খুলে দিলেন আল্লাহপাক। তখন কোলের শিশুটি বলে উঠলো“ মা তুমি হকের উপর আছ, একটু পরে জান্নাতে দেখা হবে ”। তাকেও হত্যা করা হলো। পরে মায়ের অনুরোধ ছিল তাদের সবার হাড় যেন একইস্থানে রাখা হয়। ফেরাউন মাকেও একইভাবে হত্যার পর তাদের একত্রে দাফন করেন। এই শহীদদের কবর থেকে বের হচ্ছিল জান্নাতের খুশবু।
এরপর নবীজি বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছার পর একটি ছিদ্র দেখিয়ে ওখানে বোরাককে বাঁধতে বললেন, জিবরাঈল (আ.)। নবীজি বোরাক বাঁধার পর জিবরাঈল বললেন, আল্লাহ আদম (আ.) থেকে যত নবী দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন সব নবীরা এই জায়গায় তাদের সওয়ারী বাঁধেন। বায়তুল মোকাদ্দাসে ঢুকে নবীজি দুই রাকায়াত নামাজ পড়েন। এখানে সমস্ত নবীদের একত্রিত করা হয়। এরপর সমস্ত নবীদের ঈমামতি করে নবীজি নামাজ পড়ালেন।
তার পেছনে দাঁড়িয়ে সকলে স্বীকার করে নিলেন তিনি ঈমামুল আম্বিয়া অর্থাৎ সমস্ত নবী গণের ঈমাম। ঈমামুল মুরসালিন সমস্ত রাসুল গণের ঈমাম। তবে নামাজ পড়ানো আসার সময় হওয়াই বিশুদ্ধমত।
মসজিদে আকসা থেকে নবীজিকে নিয়ে জিবরাঈল ও মিকাইল (আ.) বোরাক বাহনে উর্ধ্বাকাশে রওয়ানা হন। প্রথম আসমানে আদি পিতা হরেত আদম (আ:), দ্বিতীয় আসমানে ইছা ও ইয়াহহিয়া (আ.), তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে মুছা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে ইব্রাহিম (আ.) এর সাথে সাক্ষাত হয়। তারা সবাই নবীজিকে স্বাগত জানিয়ে প্রশংসা করেন। সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গিয়ে জিবরাঈল (আ.) জানালেন, তাঁর আর উপরে যাওয়ার অনুমতি নেই।
এরপর আল্লাহর তরফ থেকে পাঠানো ‘রফরফ’ বাহনে নবীজি আরশে আজীমে পৌঁছান। নবীজিকে আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি, আমার জন্য কি নিয়ে এসেছেন”। নবীজি উত্তরে তিনটি জিনিস নিয়ে আসার কথা বলেন। সমস্ত অগ্রিম জবানি ইবাদত, সমস্ত শারীরিক ইবাদত ও সমস্ত আর্থিক ইবাদত আল্লাহর জন্য। আল্লাহ বললেন, “হে নবী আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক ও রহমত নাজিল হোক ”। নবী তখনো বান্দাদের ভুলেন নাই। নবী বলেন, আমার উপর একা কেন শান্তি, রহমত বর্ষিত হবে। আমার বান্দা-বান্দিদের ও শরীক করেন। আল্লাহ তা কবুল করেন।
আল্লার কাছ থেকে ফিরে আসার সময় নবীজির মুছা (আ.) এর সাথে দেখা। নবীজি আল্লার কাছ থেকে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে ফিরছেন জানালে, মুছা (আ:) বললেন, আপনার উম্মত তা আদায় করতে পারবে না, কমিয়ে আনুন। এভাবে নয়বার আল্লার কাছে ফিরে গিয়ে ৪৫ ওয়াক্ত নামাজ কমিয়ে আনেন। দুনিয়ায় ফিরে আবার নবীজি আফসোস করছিলেন ৫০ ওয়াক্ত হলে উম্মত লাভবান হতো। নবীজির আরজিতে আল্লাহ বান্দাদের ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেও ৫০ ওয়াক্তের সওয়াব কবুল করেন। অন্যসব ইবাদত ওহীর মাধ্যমে পেলেও আল্লাহপাকের কাছ থেকে সরাসরি নামাজ উপহার পান মহানবী (সা.)। তাই কেয়ামতের ময়দানে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব হবে। কারণ এটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্র্ণ ইবাদত। যে ব্যাক্তি গুনাহমুক্ত অবস্থায় নিয়মিত নামাজ আদায় করবেন তার অন্যান্য ইবাদত সহজ করে দেন আল্লাহপাক।
মে’রাজ আশ্চর্যজনক ঘটনা হলেও এটি সশরীরে ছিল, স্বপ্ন যোগে নয়। নবীজির মুজেজা ছিল মে’রাজ। কোরআনে আল্লাহপাক বর্ণনা কেরেছেন, “সুবহান, এখন যে ঘটনা জানাবো, এটা বড় আশ্চর্যজনক ঘটনা, যার তার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি আল্লাহ নবীজিকে দিয়ে তা করিয়েছি”। আল্লাহ নবীজির বিভিন্ন সময়ে নির্যাতিত শরীরকে সম্মান করে আরশে আজিম পর্যন্ত নিয়েছেন। যেখানে কারো যাওয়ার অনুমতি নেই, কখনো মিলবেও না।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: