• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

সড়কে ‘মৃত্যুর সংখ্যা’ কারো মনে দাগ কাটছে না

মো. অসীম চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৪:৫৭, ১৯ মার্চ ২০২৩

আপডেট: ০০:৫০, ২৯ মার্চ ২০২৩

ফন্ট সাইজ
সড়কে ‘মৃত্যুর সংখ্যা’ কারো মনে দাগ কাটছে না

প্রতিদিন সড়কে ঝরছে প্রাণ। প্রতিদিনই খবরের কাগজে ভেসে উঠছে বীভৎস সব লাশের ছবি। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার খবর যেন আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। 
মৃত্যু গুলো এখন শুধু খাতায় 'সংখ্যা' বৃদ্ধি হয়ে থাকছে। ফলে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ ঝরলেও তা আমাদের মনকে আবেগতাড়িত করে না। নিহতের স্বজনদের আর্তচিৎকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করলেও তা যেন আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারছে না। 

 

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ২০ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৫ জন। কুতুবপুরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে রোববার সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোববার সকালে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের একটি বাস পদ্মা সেতুর আগে শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এ সময় দুমড়েমুচড়ে যায় বাসটি। তাৎক্ষণিকভাবে বাসটি থেকে ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। চিকিৎসকগন বলছেন এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। 

শিবচর হাইওয়ে থানার ওসি আবু নাঈম মো. মোফাজ্জল হক নিশ্চিত করে জানান বহু হতাহত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। 

দেশে এমন ঘটনা প্রতিদিনের। যে মানুষটি ছিল পরিবারের একমাত্র অবলম্বন, একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা  ভেঙে চুরমার করে দেয়। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটে  চালকের অসতর্কতা, অসচেতনতা, বেপরোয়া বা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালনা, ত্রুটিপূর্ণ রাস্তা। 
এর সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ওভারটেকিং প্রবণতা। সাধারণত রাস্তায় ধীরগতির গাড়িগুলোকে ওভারটেকিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। এ সময় হর্ন বাজিয়ে সামনের গাড়িকে সংকেত দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময় সংকেত না দিয়ে একজন আরেকজনকে ওভারটেক করার চেষ্টা করে, যার ফলে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি বের হতে না পেরে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তাই সঠিক নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ওভারটেক করা উচিত।

সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হল ত্রুটিপূর্ণ সড়কব্যবস্থা। মহাসড়কগুলোতে বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। রাস্তার পাশে হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ হল মহাসড়কগুলোতে দ্রুতগতির যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির যানবাহন চলাচল। গতির তারতম্য থাকায় দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধীরগতির বাহন রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে। তাই মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি।

যাত্রী অধিকার আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির রিসার্চ সেল- সদস্য আল আমিন নাহিদ জানান, চালকরা অনেক সময় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালায়, যার ফলে একসময় নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। কোনোভাবেই অসুস্থ বা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। প্রত্যেক মানুষেরই পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম প্রয়োজন।


ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই আমাদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কগুলোকে ডিজিটাল নজরদারির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সরকার, চালক, মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে- মনে রাখতে হবে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক সাবরিনা সুলতানা মিশু জানালেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন যেন কোনো খবরই নয়! অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনার ব্যাপারে আইনগত কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। সড়ক দুর্ঘটনায় কুকুর-শিয়ালের মৃত্যু হলে যতটা শোরগোল হয়, তার ছিটেফোঁটাও হয় না মানুষের মৃত্যুতে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। কাজেই এ নিয়ে কথা বলার তো কিছুই দেখি না। প্রতিটি মৃত্যুর দায়ভার সরকার কিংবা গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে এমনিতেই কমে যাবে দুর্ঘটনার পরিমাণ।

পার্বতীপুর, দিনাজপুর থেকে মেনহাজুল ইসলাম তারেক বলেন, আমাদের দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। নতুন নতুন সড়ক অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। মহাসড়কে একাধিক লেন হচ্ছে। বিপজ্জনক বাঁক ঠিক করা হচ্ছে। কিন্তু কেন রোধ করা যাচ্ছে না প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা? সড়ক-মহাসড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন তুলে দেওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে বলে মনে করি।

বিলকিছ আক্তার শিক্ষক ট্রেইনিং স্কুল, টাঙ্গাইল তিনি জানান, অনভিজ্ঞ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ওভারটেক করা, বেশি যাত্রী তোলার আকাঙ্ক্ষা, গতিসীমা বেশি থাকা, লুকিং গ্লাস না থাকা , ট্র্যাফিক সিগন্যাল না মানাসহ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। তাছাড়া চাঁদাবাজি, বকশিস নামে চাঁদা দেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সড়কে/মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে।

বর্তমান সরকারের কঠোর বিরোধী পক্ষও নিঃসংকোচে স্বীকার করবেন যে, উন্নয়ন অভিযাত্রায় সড়ক-যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এর বিপরীতে কঠিন এক জীবন সংহারের দৃশ্যপটও নির্মিত হয়েছে। যান-পরিবহণ দুর্ঘটনা যেভাবে প্রতিনিয়ত প্রাণ নিধনের দুর্বিষহ প্রতিযোগিতায় নেমেছে; পুরো জাতি এতে চরম বিচলিত-আশঙ্কাগ্রস্ত। ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেন যেন এক অজানা মৃত্যুভয় ছায়ার মতো মনের অগোচরে বাসা বেঁধে চলছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রাণপণ প্রচেষ্টায়ও এর পরিত্রাণে কার্যকর কোনো সুফল দৃশ্যমান নয়। জনগণ আর বাচনিক কোনো অঙ্গীকারে নয়, এ সংকটের আশু সমাধান প্রত্যাশা করছে।
 

মন্তব্য করুন: