• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ইমরানের মুখে যে কারণে ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ২০:০৮, ১৬ মে ২০২৩

ফন্ট সাইজ
ইমরানের মুখে যে কারণে ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগ

সংগৃহীত ছবি

পাকিস্তানের ৭৬ বছরের ইতিহসে এমন আর কখনো হয়নি৷ ’৭১-এ বাঙালিদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করতম মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে যে দেশ ক্ষমা চায়নি, সেই দেশেই কিনা শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের কথা! বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যে ভয়ঙ্কর অন্যায় হয়েছে সেরকম যেন আর না হয় পাকিস্তানে!

হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই বলছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার, সাবেক অধিনায়ক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান৷ রাজনৈতিক জীবনের ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে এবারই যে ইমরান প্রথম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন তা কিন্তু নয়৷ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বক্তব্য ইতিহাসে পাকা আসন করে নিয়েছে৷ সে আসন অবশ্য কিছুটা টলমলো৷ এই এদিকে ঝুঁকছে তো পরক্ষণেই ওদিকে৷

আত্মজীবনীগ্রন্থ ‘পাকিস্তান: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি

ক্রিকেটে পাকিস্তানের বহু জয়ের অগ্রসৈনিক ইমরান একাত্তরে পাক-সেনাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন আত্মজীবনীগ্রন্থ ‘পাকিস্তান: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি'-তে৷ ২০১১ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ে পরিষ্কার লেখা আছে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে নিজের চোখে দেখা ঢাকা শহরের কথা৷ ২৫ শে মার্চের কয়েকদিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন তরুণ ক্রিকেটার ইমরান খান৷ তখন বয়স মাত্র ১৯৷ এসেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান অনূর্ধ-১৯ দলের হয়ে ক্রিকেট খেলতে৷ খেলতে এসে লক্ষ্য করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি বাঙালিরা কতটা ক্ষুব্ধ, একই দেশের অংশ হয়েও অত্যাচারী শাসকদের কারণে অন্য অংশটিকে কতটা ঘৃণা করে বাঙালি৷ স্বশরীরে ঢাকায় আসার সূত্রে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকে ইমরান লিখেছেন, ‘‘আমরা পূর্ব পাকিস্তান দলের বিপক্ষে খেলছিলাম৷ আমাদের কাছে সবকিছুই তখন খুব শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল৷ শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শক, এমনকি প্রতিপক্ষ পূর্ব পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দেরও৷''

‘পাকিস্তান: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি' গ্রন্থে ইমরান অবশ্য দাবি করেছেন, তখন পূর্ব পাকিস্তান কতটা অন্যায়, অত্যাচার আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না৷ বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও সফল ক্রিকেট-সংগঠক সৈয়দ আশরাফুল হক ১৯৭১-এর সেই সময়টায় ইমরানের দলের বিপক্ষে লড়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে৷ ঢাকাসহ পুরো পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে নাকি সৈয়দ আশরাফুল হকই একটা ধারণা দিয়েছিলেন ইমরান খানকে৷ তার মুখে বাঙালিদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা ভীষণ দৃঢ় হয়ে উঠেছে, স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছে- এমন কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন ইমরান, ‘‘এমন কথা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম৷ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা কী ভাবছে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না৷ এ জন্য দায়ী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে গণমাধ্যমের ওপর সামরিক জান্তার পুরো নিয়ন্ত্রণ৷''


কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া বিশ্বের প্রথম সাবেক ক্রিকেটার ইমরান সম্প্রতি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন৷ সেখানেই উঠে এসেছে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য ভূমিকা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠা করা দল আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কথা৷ ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নিয়ে একটা ভিডিও প্রতিবেদন করেছে হিন্দুস্তান টাইমস৷ ভিডিও প্রতিবেদনের শুরুতেই ইমরানকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আপনারা না জানেন ইতিহাস, না বোঝেন রাজনীতি৷ আপনারা এ-ও জানেন না যে এই পাকিস্তানে কী হয়েছে৷ আমি জানি, আমার এখনো মনে আছে কী হয়েছিল (এই দেশে)৷ আমার মনে আছে একই কৌশল কীভাবে দেশের সবচেয়ে বড় দলটির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল, কিভাবে দেশের সর্বনাশ করা হয়েছিল- দেশটাকে টুকরো করে দেয়া হয়েছিল৷''

পাকিস্তানে আবার ১৯৭১-এর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে- এমন দাবি করে এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তিনি সবাইকে সতর্ক করে দেন৷ ইমরান মনে করেন, ১৯৭১ সালে নিরীহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেরকম নৃশংসতা চালিয়েছিল, এখন ঠিক সেরকম নৃশংসতাই চালানো হচ্ছে তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে৷ নয় মাসে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ হত্যা করা, লাখো নারীকে ধর্ষণ করার ঐতিহাসিক কলঙ্কের সঙ্গে ঠিক কোন কোন জায়গায় কতটা মিল রয়েছে তা অবশ্য ইমরান বলেননি৷ ভিডিও বার্তায় শুধু বলেছেন, পাকিস্তানকে আবার টুকরো করার ষড়যন্ত্র চলছে৷ তার মতে, তেহরিক-ই-ইনসাফের বিক্ষুব্ধ সমর্থকদের সরকারি ভবনে আগুন দেয়া, সেনা কর্মকর্তার ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার মতো নিন্দনীয় ঘটনাও এ ষড়যন্ত্রের অংশ৷

পাকিস্তানকে ১৯৯২-এর ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতানো সাবেক অধিনায়ক দাবি করেন, তেহরিক-ই-ইনসাফের বিক্ষোভ মিছিলে লোক ঢুকিয়ে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করা হয়েছে৷ নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এ সত্য প্রকাশিত হবে এমন আশা নিয়ে ইমরান আরো দাবি করেন, তার দলের নেতা-কর্মীরা এমন কাজ কখনো করতে পারেন না, কারণ ‘‘এ দল গত ২৭ বছরে একবারও সহিংসতায় জড়ায়নি, এই দলের সমর্থকেরা তাদের চেয়ারম্যানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার পরও শান্ত থেকেছে৷''

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই ক্ষমতাচ্যুত রাজনীতিবিদের আশঙ্কা- এখন পাকিস্তানে যা হচ্ছে সবই পরিকল্পিত৷ আগে হয়েছে ‘লন্ডন প্ল্যান', সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামা সমর্থকদের যে এখন জেলে ঢুকানো হচ্ছে তা-ও গভীর এক ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করেন ইমরান খান৷ তার আশঙ্কা- এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে তার দলকে নিষিদ্ধ করা এবং জেলে পুরে তার রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দেয়া৷


তার বেসামরিক এবং সামরিক প্রতিপক্ষরা ভুলেও যেন সেদিকে পা না বাড়ায় সেই বিষয়ে সতর্ক করে দিতে গিয়েই ইমরান বলেছেন, ‘‘আপনারা না জানেন ইতিহাস, না বোঝেন রাজনীতি৷ আপনারা এ-ও জানেন না যে এই পাকিস্তানে কী হয়েছে৷ আমি জানি, আমার এখনো মনে আছে কী হয়েছিল (এই দেশে)৷ আমার মনে আছে একই কৌশল কীভাবে দেশের সবচেয়ে বড় দলটির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল, কিভাবে দেশের সর্বনাশ করা হয়েছিল- দেশটাকে টুকরো করে দেয়া হয়েছিল৷''

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও বাঙালির মন কিন্তু ভাঙতে শুরু করেছিল ১৯৫২ থেকে৷ সেই সময় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারদের বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার কথা কে না জানে! ইমরান আহমেদ খান নিয়াজীর জন্ম সেই বছরেরই নভেম্বর মাসে৷ বাঙালির প্রতি তার দেশের শাসকদের নিষ্ঠুর আচরণের কথা জানতে তাকে ঢাকায় আসতে হয়েছিল ১৯ বছর পরে৷ সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা ‘পাকিস্তান: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি' গ্রন্থে লিখেছেন ২০১১ সালে৷ চার বছর পরই কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা যেন সকল গুরুত্ব হারিয়ে বসেছিল৷  তাই ২০১৫ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ফাঁসি দেয়ার পর ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান সামান্য জানান দিতে শুরু করা তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলনেতা ইমরান খান৷ ইমরান তখন বুঝতে পারেননি সাকা চৌধুরী আর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের কী অপরাধ৷

হঠাৎ আবার ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের অতীত উঠে আসছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে৷

১৯৭১, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি, বাঙালির জাত্যাভিমান, সুদীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, শহিদ, শহিদের রক্ত, বাংলার স্বাধীনতা- এসব এখনো সত্যিই ভালো করে বুঝতে পারছেন তো, নাকি নিজের প্রয়োজন বলেই শুধু কথার কথা বলছেন ইমরান খান?

মন্তব্য করুন: