• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

জিয়াউর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী

জিয়ার কূটনীতি: ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

প্রকাশিত: ১৫:৩৪, ৩০ মে ২০২৩

আপডেট: ১৫:৩৬, ৩০ মে ২০২৩

ফন্ট সাইজ
জিয়ার কূটনীতি: ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’

ভারতের বিরোধিতার মুখে সার্ক গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান

আজকের আঞ্চলিক- উপআঞ্চলিক ও বিশ্ব স্নায়ু চাপের এ সন্ধিক্ষণে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কূটনৈতিক কৌশল ও পররাষ্ট্রনীতিতে জাতীয়তাবাদী উপাদানের সংযোগ বড় প্রাসঙ্গিক। দেশের এক কঠিন সময়ে ক্ষমতার দৃশ্যপটে অভিষেক তার। তখন বড় প্রশ্ন ছিল তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন কিনা। জিয়া শেষতক কুলিয়ে উঠতে পারবেন না মর্মে বহু আগাম মূল্যায়ণও ছিল বিশিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও মহলের। ওইসব মূল্যায়নের যুক্তি ও বাস্তবতাও ছিল। একদিকে দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর  রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পরে নৈরাজ্যের নারকীয়তা, আরেকদিকে অভাব। তলাবিহীন ঝুড়িসহ নানা বদনাম বাংলাদেশের।


উত্তরাধিকারের মতো প্রাপ্ত কঠিন ওই সময়ে দেশ পরিচালনার মাঝে পররাষ্ট্রনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসেন জিয়া। যা ঝানু-পেশাদার কূটনীতিকদেরও তাজ্জব বানিয়ে দেয়। একজন সমরনায়কের কূটনীতির মাঠ দাবড়ানো মিরাকলও মনে হতে থাকে অনেকের কাছে। ক্ষমতার বসার কিছুদিনের মধ্যে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে সার্ক গঠনের মতো ঘটনায় তাদের চোখ কপালে উঠে যায়।

 আঞ্চলিক রাজনীতিতে তখন কোনো দেশের পক্ষে কর্তৃত্ববাদী ভারতকে মোকাবিলা করা ছিল ধারনারও বাইরে। তিনি সেটা করতে পেরেছিলেন জাতীয়তাবাদের উপাদান মাখানো সুক্ষ কূটনীতিতে । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে একটি ভারসাম্য আনেন এ অঞ্চলের রাজনীতিতে। ভারতের বিরোধিতার মুখে তখন সার্কের উদ্যোগ নেওয়া সহজ ছিল না। আর ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে জাতিসংঘে চলে যাওয়া ছিল দুঃসাহসের বিষয়। সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর মতো। 


কূটনীতির নিজস্ব একটি ধারা তৈরির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সেই অভিযাত্রায় নেমেছিলেন। দেশে বহুদলীয় রাজনৈতিক চর্চা এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের কূটনীতির সুবাদে তার সময়েই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে নির্বাসন থেকে দেশে আসেন। ওই প্যাকেজে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতার দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামি দল আবার রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়।

তার ওই রাজনীতি-কূটনীতির আরো ফসলের মধ্যে রয়েছে পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্সের দুয়ার খোলা । মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানো, পোশাক শিল্পের সূচনা ওই সময়ের জন্য ছিল বিস্ময়কর-অসম্ভবকে সম্ভব করা গল্পের মতো।  এ সাফল্যের পেছনে তার ব্যক্তিগত সততা, দৃঢ়তা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলস পরিশ্রমের একটি রসায়নও ছিল। জিয়াউর রহমান তার প্রজ্ঞা ও জাতীয়তাবাদের চেতনায় মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটিনৈতিক সম্পর্কের অচলাবস্থার ইতি ঘটান। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশি রেমিটেন্সের পাইপ লাইন তৈরি করেন।


জিয়ার কূটনৈতিক নীতিমালায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিশেষ একটি বলয় তৈরি হয়। যা প্রতিবেশী ভারতসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্ব এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক নৈকট্য আনে। আবার সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে এনে মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রাচ্যের আরেক পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথেও সম্পর্ক স্থাপন হয় জিয়ার কূটনৈতিক ধারায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্কে স্বাধীনতার পর থেকেই শৈথিল্য বিরাজ করছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পাচ্ছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি জনশক্তি পাঠানোর যে সুফল বাংলাদেশ পেয়ে আসছে তা তখনই বুঝতে পারা জিয়াউর রহমানকে কূটনীতিক হিসেবে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। 
সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল।

চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পুনর্গঠনের কাজ অনেকটা তরান্বিত করেছিলেন। সামরিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উন্নত কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে জিয়া রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। এসব কূটনীতি প্রতিবেশী ভারতের সাথে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করে। সেটা কাভার দেয়ার চেষ্টা করা হয় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা-সার্ক দিয়ে। জিয়ার উপলব্ধিতে ছিল আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা গড়লে  বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বাড়বে। এতে উপকৃত হবে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশও। এসব বহুমুখী সমীকরণে সার্কের রূপরেখা রচনা করেন তিনি। যা বাস্তব রূপ পায় তার মৃত্যুর পর  ১৯৮৫ সালে।

বলার অপেক্ষা রাখে না,  বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদা দিতে গিয়ে তিনি অনেকের চক্ষুশুলও হন।  যা তার  প্রাণহানি ডেকে আনে বলেও মত আছে অনেকের।  
রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক চরিত্র হারালে সার্বভৌমত্ব দুর্বল হয়। আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তির সাথে ভারসাম্য আনতে ব্যর্থ হয়। জিয়াউর রহমান তা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই জাতীয়তাদকে টপ প্রায়োরিটি দিয়ে সাজিয়েছিলেন তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। যার ভিত্তি ছিল  ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’। যা দিয়ে আঞ্চলিক শক্তির ক্ষমতাকে ব্যালান্স করতে সেই শক্তির সাথে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শক্তিশালী দেশগুলোকে একই সুতায় বাঁধতে সক্ষমও হয়েছিলেন। দেশকে আধিপত্যবাদের বলয় থেকে বের করে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতে দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়তে পেরেছিলেন। দেশের মর্যাদা ও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় এনে দিয়ে গেছেন। 

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট 

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

মন্তব্য করুন: