• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মনে আছে তো মাহফুজ উল্লাহ`কে ?

মোহাম্মদ অলিদ বিন সিদ্দিক তালুকদার

প্রকাশিত: ১৩:৫৬, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ফন্ট সাইজ
মনে আছে তো মাহফুজ উল্লাহ`কে ?

কেন, কী বুঝে যে মাহফুজ উল্লাহ ভাই মৃত্যুর মাস কয়েক আগে কিছু ঘটনার কারণে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন,! আজ যারা নানান কাজে আসে, আমাকে ব্যবহার করে, যাদের জন্য এতো কিছু করছি, তারা কি মনে রাখবে? দ্বিমত বা একমত কোনোটাই না করে আমি বলেছিলাম, সবাই মনে নাও রাখতে পারে। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর না যেতেই বাস্তবে সেই ভুলে যাওয়ার নমুনা উপলব্ধি করছি ।  এটাই বুঝি নিদারুণ বাস্তবতা। 

 

প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট মাহফুজ উল্লাহর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পাঁচ বছর আজ। বছরে বছরে নয়, প্রতিটি দিনই তিনি আমার কাছে স্বরণীয় - বরণীয়। স্মরণ আর দোয়া করা ছাড়া তার জন্য কিছু করার আর কোনো সাধ্য  নেই ও আমার। গত চার বছরের মতো এবারও " মাহফুজ উল্লাহ স্মৃতি পরিষদ " আয়োজিত ২৭ এপ্রিল, শনিবার দিনটিতে আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকে কিছু করণীয় তাঁর প্রাপ্য গুলো হক আদায় করে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকি। কর্মসূচি মধ্যে, সকালে তাঁর কবরস্থান জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ ও ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন। তারপর দুপুরে জোহরের নামাজের পরে তার জন্য দোয়া খায়ের, কোরআন খতম ও এতিমদের মধ্যে খাবার বিতরণের আয়োজন করেছি ।

২০১৯ সালের এই দিনে বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ১০মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ১৯৫০ সালের ১০মার্চ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের সম্ভান্ত্র পরিবারে মাহফুজ উল্লাহ জন্ম। তার বাবা হাবিবুল্লাহ এবং মা ফয়জুননিসা বেগম । ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুজাফফর আহমেদের দৌহিত্র তিনি।

মাহফুজ উল্লাহ শুধুমাত্র বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিকই নন, একাধারে, লেখক, কলামিস্ট, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, ও পরিবেশবিদ ছিলেন তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর ছিলেন। বাংলাদেশে তিনিই সম্ভবত প্রথম পরিবেশ সাংবাদিকতা শুরু করেন। আন্তর্জাতিকভাবে একজন সক্রিয় পরিবেশবিদ হিসেবে পরিচিত মাহফুজ উল্লাহ। সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নামক একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহফুজ উল্লাহ । আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর করজারভেশন অব নেচারের আন্তর্জাতিক পরিচালনা পর্ষদের প্রথম বাংলাদেশি সদস্য তিনি। 

ছাত্রাবস্থাতেই মাহফুজ উল্লাহ সাংবাদিকতা পেশায় নিবেদিত হন। বাংলাদেশের একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্মলগ্ন ১৯৭২' থেকে কাজ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি শিক্ষকতা ও করেছেন মাহফুজ উল্লাহ। চীন গণপ্রজাতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপদূতাবাসে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।

মৃত্যুর আগে শিক্ষকতা করেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে। মাহফুজ উল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করা মাহফুজ উল্লাহ রাজনীতিতে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ১১দফা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাহফুজ উল্লাহ। ছাত্র রাজনীতির অপরাধে আইয়ুব খানের সাময়িক শাসনামলে বহিষ্কার হন ঢাকা কলেজ থেকে। বাম রাজনীতি দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করলেও শেষদিকে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে । এক সময় রেডিও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি ছিল মাহফুজ উল্লাহর। উপস্থাপনাও করেছেন। টকশোতে থাকতেন নিয়মিত। ২০০৭ সালে এক এগারোর পর জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকারের জরুরি আইনের সময়ে, রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে যে কয়েকজন নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে যৌক্তিক মতামত জাতির সামনে তুলে ধরেছেন তাদের মধ্যে মাহফুজ উল্লাহ অন্যতম। 

সাংবাদিকতার পাশাপাশির বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৫০ এর অধিক বই লিখেছেন মাহফুজ উল্লাহ। বইগুলো আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিলাভ করেছে । বইগুলোর অধিকাংশই বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সংগৃহীত আছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য :
হচ্ছে - " প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ : পলিটিকাল বায়োগ্রাফি ; যাদুর লাউ ; যে কথা বলতে চাই ; অভ্যুত্থানের ঊনসত্তর ; পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ; গৌরবের দিনলিপি ; ( ১৯৫২/৭১-), ; উলফা অ্যান্ড দ্য ইনসারজেন্সি ইন আসাম ; স্বাধীনতার প্রথম দশকে বাংলাদেশ, ;। তাছাড়া ২০১৮ সালের শেষ দিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে লিখেন, ; বেগম খালেদা জিয়া -( হার লাইফ হার স্টোরি,) । এই বইটি দেশ ও বহিবিশ্বে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ।

 এই আত্মজীবনী গ্রন্থটি আমার মাধ্যমে প্রকাশনায় দেশের স্বনামধন্য বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দি ইউনিভার্সেল একাডেমি বাংলাবাজার ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ও তার অন্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বই প্রকাশ আমি আমার পক্ষ থেকে " দি ইউনিভার্সেল একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে । আমার মাধ্যমে যেগুলো বই প্রকাশ করা হয়েছে তারমধ্য অন্যতম - মুক্ত জীবন রুদ্ধপ্রাণ " "রাজনৈতিক ছড়া " এই দুটি বই প্রকাশ ( কপিরাইট -) সহ আমাকে প্রদান করেন বিগত ২০১৭ সালের অমর একুশে গ্রন্থ মেলায়। তার জীবনের একদম সর্বশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস বই ( এ কী কেবলই প্রেম,) । এই বইটিও আমি প্রকাশ করি ২০১৯ সালের অমর একুশে গ্রন্থ মেলায়, আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দি ইউনিভার্সেল একাডেমি থেকে। এই উপন্যাস বইটি যেদিন বাংলাবাজার প্রেস থেকে সবেমাত্র প্রকাশ করে বিকেলে দিকে চলে আসলাম মাহফুজ উল্লাহ ভাইয়ের অফিসে ধানমন্ডি। বইটি হাতে তুলে দিলাম। উলোটপালোট করে দেখে দেখে খুবই খুশি হলেন। এমতাবস্থায় একটি বই হাতে নিয়ে সাথে সাথে অটোগ্রাফ দিলেন এবং তার বুকের মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিলেন সেই সাথে ছবি উঠাইলেন। 

সত্যকে সত্য বলতে দ্বিধা না করার স্বভাব - বৈশিষ্ট্য মাহফুজ উল্লাহর ছাত্র জীবন থেকেই। এক স্মৃতিচারণে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা নূহ উল আলম লেনিন বলেন, রাজনৈতিকভাবে তিনি ও মাহফুজ উল্লাহ ভিন্ন মতের হয়েও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । বর্তমান সংস্কৃতিতে মতপার্থক্য হলে কেউ কারও ছায়া মাড়ান না উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, মাহফুজ উল্লাহ তেমন ছিলেন না । আমার আরেক শ্রদ্ধাভাজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদের আশা ছিল মাহফুজ উল্লাহর গুনগুলো যেন তরুণদের আয়ত্তে নিয়ে আসে। তার ওই প্রত্যাশা কতোটা ফলেছে। এ নিয়ে কোনো মত দেয়ার সাহস আমার নেই । তবে অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্ভীকভাবে সত্য বলার যে দৃষ্টান্ত মাহফুজ উল্লাহ ভাই রেখে গেছেন তা প্রেরণার উৎস হয়ে হয়ে আমার কাছে। তিনি বেঁচে থাকবেন স্বচ্ছ - পরিছন্ন ব্যক্তি হিসেবে। মাহফুজ উল্লাহ ভাই স্বশরীরে বেঁচে থাকলে আমার মতো আরো অনেকে সাহসের বাতিঘর পেতাম । তার পরিবেশ সাংবাদিকতা আজকের এ প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় প্রাসঙ্গিক ও জরুরি । বাংলাদেশ একদিন মরুময়তার শিকার হবে, এ বার্তা সেই কবে দিয়ে গেছেন তিনি। পরিবেশ সম্পর্কে মাহফুজ উল্লাহ ভাই যে বার্তা দিয়ে গেছেন তার মর্মার্থ এখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি না করে উপায় আছে তাপদাহপীড়িতদের। 

পরিশেষে মাহফুজ উল্লাহ ভাইয়ের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে, সকলের নিকট তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া কামনা করছি । 

লেখক :  ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোস্ট

মন্তব্য করুন: