প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুন্ড্রনগরে একদিন

৪০০-১৫০০ সাল পর্যন্ত করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠে এই প্রসিদ্ধ নগরী
ধ্বংস হওয়া রাজ্য, রাজপ্রাসাদ, ইতিহাস যা ঘিরে রেখেছে অপ্রতিরুদ্ধ এক প্রশস্ত দেয়াল । যে দেয়াল ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ ছিল দুস্কর । দেয়ালের প্রশস্থ এতটাই যে এর উপর দিয়ে অনায়াসে দুই-তিনটা ঘোড়া একসাথে দৌড় দিতে পারতো । প্রশস্ত দেয়ালের কথা শুনে অনেকের মাথায় আসতে পারে চীনের নাম কিন্তু না এইটা চীন নয় । বলছি ইতিহাসের চাদরে মোরা প্রাচীন বাংলার রাজধানী '' পুন্ড্রনগরের '' কথা, বর্তমানে যার নাম মহাস্থানগড়। বিধস্ত নগরী বিলীন হলেও এর রয়েছে স্বর্ণালী ইতিহাস । ধ্বংসাবশেষগুলো দেখলেই বুঝা যায় এর সময়টা কতটা গৌরবময়, কতটা ক্ষমতাধর ছিল এর রাজা, আর কতটা বিত্তশালী ও আভিজাত্যে ভরপুর ছিল এই জনপদ ।
৪০০-১৫০০ সাল পর্যন্ত করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠে এই প্রসিদ্ধ নগরী । সে সময়ে এটিই ছিল এই অঞ্চলের রাজধানী । খুবই শক্তিশালী ও পরাক্রমী ছিল এই জনপদ । কোষাগার বিভিন্ন ধন-রত্নে পরিপূর্ণ ছিল । ছিল হাতিশাল-ঘোড়াশাল, দাস-দাসী, রাজা-প্রজা, ইমারত, মন্দির, বাগান, অস্ত্রাগার আর এক দুর্ভেদ্য বেষ্টনী । নদীর তীরে গড়ে উঠার কারণে এটি হয়ে যায় বাণিজ্যের কেন্দ্র বিন্দু । যখন ইউরোপ-আমেরিকা সভ্য হতে শেখেনি, তখন থেকেই এ অঞ্চলে বণিকরা আসত ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন এবং আরও অনেক হিন্দু রাজারা এ অঞ্চলকে বানিয়ে ছিলেন তাদের প্রাদেশিক রাজধানী ।
ইতিহাস থেকে এখন আসি বর্তমানে অর্থাৎ ভ্রমণ কাহিনীতে । স্কুল জীবন শেষ করার পরেও স্কুলের বন্ধুরা মিলে প্রতিবছর গেট-টুগেদার করে থাকি । ক্লাসের সব থেকে ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট স্বপ্নার ইচ্ছে অনুযায়ী ঠিক করা হলো মহাস্থানগড় । এক-একজন এক-এক প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত তাই সবার সুবিধার্তে সরকারি ছুটির দিনকে বেঁচে নিলাম । আয়োজনের দায়িত্ব পরলো মিল্টনের কাঁধে । ও-যে এইসবে একাই একশো তার প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি । তাই নিশ্চিন্তে ওর কাঁধে সব ঝামেলা অর্পণ করি । প্ল্যান অনুযায়ী সে সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে সব কিছুর আয়োজন করলো । এইদিকে সবাই বাড়ি ফিরতে লাগলো । নির্দিষ্ট দিনে সবাই মিলে খাবারসহ রওনা দিলাম মহাস্থানের উদ্দেশ্যে । সকাল ১০টায় পৌঁছিলাম আমাদের গন্তব্যে । প্রথমে গিয়ে আমরা নামলাম ট্যুরিজম স্পটে । প্রাচীন কাঠামোর পাশে নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে এই স্পটটি । মনোমুগদ্ধকর কয়েকটি ছাউনি, ফুলের গাছ , ইটশৈলীতে বানানো রাস্তা আর পাশে প্রবাহমান নদী এ যেন প্রকৃতির মাঝে অপরূপ সাঁজে সজ্জিত এক বিশ্রামাগার । সাউথ এশিয়ান ট্যুরিমজম ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এসএটিআইডিপি) বা দক্ষিণ এশীয় পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার কাজে অর্থায়ন করছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ।
তারপর ৫মিনিট হেটে গেলাম গোবিন্দ ভিটায় । এ প্রত্নস্থলটি করতোয়া নদীর বাঁকে মহাস্থানগড় দুর্গ নগরীর সন্নিকটে উত্তর দিকে অবস্থিত । এটি সেই সময়ের মন্দির । রাজা পশুরাম এই মন্দিরে পূজা করতেন । খনন কালে এখান থেকে বিভিন্ন যুগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে । ‘করতোয়া মহাত্ম্য’ গ্রন্থে এ মন্দিরটির কথা উল্লেখ রয়েছে ।
মন্দিরের অপজিটে রয়েছে পিকনিক স্পট । ২০টাকা টিকেটে ঢুকে পড়লাম । স্পটটিতে রয়েছে উঁচু দেয়ালে উঠার জন্য দৃষ্টিনন্দন কাঠের সিঁড়ি । এই সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম চীনের গ্রেটওয়ালের মতো প্রাচীরে । দৈর্ঘ্য ৫০০০ ফুট আর প্রস্থ ৪৫০০ ফুট সমতলভূমি থেকে এ দেয়ালের উচ্চতা ১৫ ফুট কোথাও কোথাও এর থেকেও বেশি । দীর্ঘাকৃতির এ প্রাচীরই বলে দেয় সমৃদ্ধ এই নগরীর রাজা নিরাপত্তাকে কতটা গুরুত্ব দিতেন । লাখ লাখ পোড়ামাটির ইট আর সুরকি এবং নির্মাণ শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে তৈরী করা হয়েছে এই প্রাচীরটি । এছাড়াও এখানে রয়েছে বসার জায়গা, খোলা মাঠ, ব্রীজ , রান্নার চুলা আর কিছু দোকান কিন্তু এর সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রাখতে বর্তমানে জায়গাটিতে আর রান্না বা পিকনিক করতে দেওয়া হয়না । পিকনিকের জন্য ট্যুরিজম স্পটে রয়েছে আলাদা জায়গা ।
এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করলাম । জাদুঘরটিতে রয়েছে প্রাচীন কিছু পোড়ামাটির ফলক, স্বর্ণ ও রোপ্য মুদ্রা ,অস্ত্র, ধ্বংসাত্মক কিছু মূর্তি । প্রতিটি নিদর্শনের পাশে লেখা রয়েছে নিদর্শন সম্পর্কে কিছু কথা আমাদের জ্ঞান পিপাসু বন্ধু যতন কুমার প্রতিটি বাক্য যেন মুখস্থ করতে ছিল । জানা যায় এখানে আরও অনেক মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সংঞ্জাম ছিল কিন্তু তা সরিয়ে ঢাকা ও বিদেশে পাঠানো হয় । সেই নিদর্শনগুলো থাকলে দর্শনার্থীরা হয়তো আরো গুরুত্বত্বপূর্ণ ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা নিতে পারতো ।
বন্ধু নিয়মের কথায় গেলাম শীলাদেবীর ঘাটে ও এখানে এর আগেও বহুবার এসেছে ওর ভাষ্যমতে, ‘’এখানে রাজা পশুরামের বোন শীলাদেবী তার সঙ্গীদের নিয়ে স্নান করত। পরশুরাম পরাজিত হবার পর শীলাদেবী করতোয়া নদীর এই স্থানে জলে ডুবে আত্মহুতি দেন। এরপর থেকে স্থানীয় হিন্দুধর্মালম্বীরা এই স্থানে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমীতে এবং ১২ বছর পরপর পৌষ-নারায়ণী স্নানের উদ্দেশ্যে এই স্থানে যোগ দিয়ে থাকেন’’।
পুন্ড্র সভ্যতার এক অলৌকিক কাহিনীতে মোরা জিয়ৎ কুণ্ড ইতিহাসবিদদের মতে, পানির অভাব দূর করার জন্য রাজপশুরাম কর্তৃক এই কূপটি নির্মিত হয় ১৮শ-১৯শতকের মাঝামাঝি সময়ে কিন্তু এলাকার জনগণ ও কিংবদন্তীদের মতে, এই কূপের পানিতে অলৌকিক ক্ষমতা ছিল যা পান করলে মৃতরাও জীবিত হয়ে উঠতো । যুদ্ধে রাজা তার মৃত সৈন্যদের এই পানি পান করিয়ে জীবিত করে তুলতেন । নানা মুনির নানা মতের সত্যতা প্রমাণ করার দিকে আমরা আর না যাই আমরা দর্শনার্থী তাই দর্শনেই তৃপ্তি মেটাই ।
সবশেষে আমরা গেলাম কাঙ্খিত সেই মাজারে যার সাথে জড়িয়ে আছে এক বিজয়ের ইতিহাস । মাজারটি হজরত শাহ্ সুলতান বলখী (রহ.) মাহী সওয়ারের । মাহী সওয়ার নাম হওয়ার কারণ তিনি মহাস্থানে প্রবেশ করেছিলেন করতোয়ার মধ্যে দিয়ে বিশাল এক মাছের পিঠে চড়ে । মহাস্থানে প্রবেশ করে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন । রাজা পশুরামের অনেক সৈন্য সেনাপতি ও প্রজারা ইসলাম গ্রহণ করলেও রাজা পশুরাম করেননি তিনি মাহী সওয়ারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং পরাজয় লাভ করেন । সম্মুখ যুদ্ধে তার মৃত্যু ঘটলে পশুরাম অধ্যায়ের অবসান ঘটে । রাজা পশুরামই ছিলেন পুন্ড্র নগরের শেষ রাজা । মাহী সওয়ার এই মাজারের পাশের মসজিদে ইবাদত করতেন । তাই তার মৃত্যুর পর মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করে মাজার নির্মিত হয় যা সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৪৫ ফুট উঁচুতে । এখানে একটি আশ্চর্য নিদর্শন রয়েছে । মাজারের ভেতরের একটি বড়াই গাছ (কুলগাছ ) যেইটাতে কোন কাটা নেই যা দেখতে হলে অবশ্যই আপনাকে এই স্থানে আসতে হবে । সময়ের পরিক্রমায় ও ট্যুরিজম বিভাগের পদক্ষেপে প্রাচীন এই স্থানটিতে যুক্ত হয়েছে বর্তমানের কিছু অবকাঠামো যা জায়গাটিকে অপরূপ সৌন্দর্যে বর্ধিত করেছে । সৌন্দর্য ও ইতিহাস দর্শনে একবার হলেও এই স্থানটিতে আসা অনেক বেশি জরুরি । এখানে আসলেই জানা যাবে বাংলার সেই গৌরবময় ইতিহাস । গৌরবে বুক চওড়া হয়ে যাবে এইটা ভেবে যে, বাংলাও একসময় শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ।
এখানে আরো কিছু নিদর্শন আছে নানা কারণে সেগুলোতে যাওয়া হয়নি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেহুলার বাসর ঘর, পদ্মাদেবীর ঘাট । তারপরেও বলতে চাই জীবনের অন্যতম সেরা একটি ভ্রমণ ছিল যেখানে পেয়েছি ইতিহাসের স্বাদ ।
যাতায়াত
মহাস্থানগড়ের অবস্থান বগুড়া শহর থেকে থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার(৬.৮ মাইল) উত্তরে বগুড়া রংপুর মহাসড়কের পাশে করতোয়ার তীরে অবস্থিত । বগুড়া থেকে বাস, সিএনজি বা অটোতে মহাস্থানে যাওয়া যায় যার ভাড়া ২০টাকা । এছাড়াও মহাস্থানগড় থেকে বেহুলা সুন্দরীর বাসরঘরে যেতে আলাদা ৩০টাকা গুনতে হবে । আর খাওয়ার জন্য খুব ভালো ব্যবস্থা নেই । ট্যুরিজম স্পট এ একটি ক্যান্টিন রয়েছে যার খাবারের মানের তুলনায় দাম অনেক বেশি । এইদিক থেকে খাবার নিয়ে যাওয়া বা বগুড়ায় গিয়ে খাওয়ার শ্রেয় । এছাড়াও দূরের দর্শনার্থীরা বগুড়ার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে থাকতে পারেন ।
লেখক: গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে শিক্ষার্থী
মন্তব্য করুন: