উত্তরের কৃষকের নতুন আশার প্রতীক ব্রি ধান-১০৩
উত্তরের কৃষক সমাজে নতুন আশার সঞ্চার করেছে খরাসহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল ধানের নতুন জাত ব্রি ধান-১০৩। অল্প সময়ের জীবনকাল, অধিক ফলন এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ধানের এই জাত। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যখন উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় খরার প্রকোপ বাড়ছে, তখন ব্রি ধান-১০৩ যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে কৃষকদের জন্য।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত এই জাতটি মূলত খরাপ্রবণ এলাকায় চাষের জন্য তৈরি করা হয়েছে। সাধারণত বোরো বা আমন মৌসুমে পানি সংকট দেখা দিলেও, এই জাত স্বল্প পানিতেও ভালোভাবে বেড়ে ওঠে এবং ফলন দেয় প্রায় ৬ থেকে ৬ দশমিক ৫ টন হেক্টর প্রতি।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রি ধান-১০৩ অন্যান্য প্রচলিত জাতের তুলনায় মাঠে ১০ থেকে ১৫ দিন কম সময় নেয়। এর জীবনকাল মাত্র ১২০ থেকে ১২৫ দিন, ফলে এক মৌসুমে এই ধান কাটার পর সহজেই পরবর্তী ফসল যেমন গম, ভুট্টা, আলু বা ডাল চাষের সুযোগ থাকে।
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার রশিদপুর গ্রামের কৃষক অহিদুল ইসলাম, তাহের আলী, সামছুল আলম শফিয়ার রহমান জানিয়েছেন, আমরা আগে শর্না জাতের ধান চাষ করতাম। খরার সময় ফলন কমে যেত। এবার প্রথমবার ব্রি ধান-১০৩ এক একরে করেছি, ফলনে খুবই খুশি। কম পানি দিয়েও ধান ভালো হয়েছে, গাছও শক্ত, রোগ বালাইও নাই। বাতাসেও হেলে পরে না।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, এই জাতটির আরেকটি বিশেষ গুণ হলো- এর রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা। ধানের ব্লাস্ট, বাদামী দাগ, এবং ব্যাকটেরিয়াল রোগের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। ফলে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক খরচও অনেকটা কমে যায়।
ধান গবেষণা কেন্দ্র গাজীপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নজমুল বারী বলেছেন, গতানুগতিক জাতের চেয়ে ব্রি-১০৩ ধান কৃষকের জন্য আশীর্বাদ। দেশে প্রতি বছর আবাদী জমি কমছে। এজন্য চাষ পদ্ধতি পরিবর্তন করে কম খরচে ভালো ও বেশি ফলন পেতে এই ধান সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

১৩৭ সেন্টিমিটার লম্বা গাছ হওয়ায় এটি শুধু ধান উৎপাদনেই নয়, গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবেও উপযোগী। কৃষকরা জানান, ধান কেটে নেওয়ার পর খড় শুকিয়ে গরু ও মহিষের জন্য সংরক্ষণ করা যাচ্ছে, যা তাদের পশু খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আঞ্চলিক কার্যালয় রংপুরের প্রিন্সিপাল সাইন্টিফিক অফিসার ড. রকিবুল হাসান বলেন, খরাসহিষ্ণু জাত হিসেবে ব্রি ধান-১০৩ উত্তরাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এটি তুলনামূলক কম ইনপুটে বেশি ফলন দেয়। কৃষকদের মাঝে এই জাত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। চলতি আমন মৌসুমে ব্রি আঞ্চলিক কার্যালয়ের বাস্তবায়নে ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায়
দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে তিন হাজার বিঘা জমিতে এই ধানের চাষ হচ্ছে। প্রাথমিক ফলাফল কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের আশাবাদী করে তুলেছে।
রংপুরের আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার শাহাদত হোসেন জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে খরা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এখন বড় চ্যালেঞ্জ। উত্তরাঞ্চলে অনেক সময় বৃষ্টির অভাবে সেচ খরচ বেড়ে যায়, ফলন কমে যায়। সেখানে ব্রি ধান-১০৩ জাতটি খরা পরিস্থিতিতে টিকে থেকে ভালো ফলন দেওয়ায় কৃষকের খরচ কমবে, লাভ বাড়বে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ফসল কর্তন ও মাঠ দিবস হয় রংপুরের মিঠাপুকুরে। এসময় দেখা যায়, ব্রি ধান-১০৩ গাছের রং গাঢ় সবুজ, শিষ বড়, ধান দানাও মোটা। ফলন অন্য জাতের চেয়ে অনেক ভালো।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানান, ব্রি ধান-১০৩ উন্নত জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে খরায় টিকে থাকতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মাটির আর্দ্রতা ব্যবহার করে ফলন ধরে রাখতে সক্ষম। পাশাপাশি এই জাতের দানার মানও উন্নত রান্নার পর ভাত ঝরঝরে এবং স্বাদে উন্নতমানের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটলে শুধু খরা অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, বরং কৃষকের আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। ব্রি ধান-১০৩ এখন শুধু একটি নতুন জাত নয়, বরং এটি উত্তরাঞ্চলের কৃষকের নতুন আশার প্রতীক হয়ে উঠছে।
বিভি/পিএইচ




মন্তব্য করুন: