শিক্ষক দম্পতি হত্যা: ময়নাতদন্তে মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য

গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানাধীন বড়বাড়ির বগারটেক এলাকার সড়কে প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে শিক্ষক দম্পতির মরদেহ উদ্ধারের প্রায় ৩৮ ঘণ্টা পর থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। শুক্রবার রাতে নিহতের ভাই আতিকুর রহমান বাদী হয়ে হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করা হয়েছে।
জিএমপির গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং নিহত প্রধান শিক্ষকের ছোট ভাই ওয়াসিম হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান শাফি মোহাইমেন জানিয়েছেন, নিহতদের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। দু’জনেরই ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে। এটা খাবারে বিষক্রিয়া বা অন্য কোন কারণেও হতে পারে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তাদের শরীরের বিভিন্ন নমুনা ঢাকায় সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভোরে গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানার বড়বাড়ির বগারটেক এলাকার সড়কের পাশে দাঁড়ানো নিজ প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে গাড়ীতে বসা অবস্থায় এক শিক্ষক দম্পতির মরদেহ তাদের স্বজনেরা উদ্ধার করেন।
এ ঘটনাকে ঐ দম্পতির স্বজনরা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দাবি করছেন। তারা বলছেন, গাড়ীতে তাদের সঙ্গে থাকা কোন কিছুই খোয়া যায়নি। শুধু তাদের মৃত্যু হয়েছে। স্বজনরা সুষ্ঠু তদন্ত করে এর বিচার দাবি করেন। এ ঘটনার পর ৩৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও এই মৃত্যুর রহস্যজট খুলতে পারেনি। তবে, পুলিশের একাধিক টিম এ জন্য কাজ করছে।
মৃত্যুবরণকারীরা হলেন, এ কে এম জিয়াউর রহমান মামুন (৫১)। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার দড়ি কাঁঠাল গ্রামের মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে। তিনি টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী মোসা: মাহমুদা আক্তার জলি (৩৫)। আমজাদ আলী সরকার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা গাজীপুর মহানগরীর ৩৬ নং ওয়ার্ডের গাছা থানাধীন কামারজুরি এলাকায় বসবাস করতেন।
শিক্ষক জিয়াউর রহমান মামুনের ভাই ও মামলার বাদি আতিকুর রহমান জানান, তার ভাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানার কামারজুরি এলাকার নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। জিয়াউর রহমান মামুনের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দড়ি কাঁঠাল এলাকায়। জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী জলি টঙ্গীর পৃথক স্কুলে চাকরি করলেও তারা প্রতিদিন একসঙ্গে নিজস্ব প্রাইভেটকারে স্কুলে যাওয়া আসা করতেন।
বুধবার (১৭ আগস্ট) স্কুলের কাজ শেষে বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে মামাতো ভাইকে গাড়িতে তুলে জিয়াউর নিজে গাড়ি চালিয়ে স্ত্রী জলির স্কুলে যায়। সেখান থেকে জলিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। পথে মামাতো ভাইকে রাস্তায় নামিয়ে দেন তারা। জিয়াউর রহমানের ছেলে এ কে এম তৌসিফুর রহমান মিরাজ সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে তার বাবার মোবাইলে ফোন দেন। কিন্তু বাবার ফোন রিসিভ না হওয়ায় তার মায়ের ফোনে ফোন দিচ্ছিলেন। পরে মা ফোন ধরে বাসায় আসার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা পথে আছি, কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় আসছি। কিন্তু তাঁরা আর রাতে বাসায় ফেরেননি। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁদের সন্ধান পাইনি। পরে বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে বাসায় ফেরার পথে গাছা থানাধীন বড়বাড়ী জয়বাংলা সড়কের বগারটেক এলাকায় নিজ প্রাইভেট কারের ভেতরে স্টিয়ারিংয়ে প্রধান শিক্ষক ও পাশে তাঁর স্ত্রীকে নিস্তেজ অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের গাড়ি থেকে বের করে প্রথমে তায়রুন্নেছা হাসপাতাল ও পরে উত্তরা নস্ট্রামস হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।
ওই দম্পতির ছেলে তৌসিফুর রহমান মিরাজ জানান, মোবাইলে কথা বলার সময় মায়ের কথাবার্তায় ক্লান্তির ভাব বুঝতে পারি। এর দীর্ঘক্ষণ পরও বাসায় না আসায় আমি পুনঃরায় ফোন করি। কিন্তু তখন রিং বাজলেও বাবা-মা কেউ ফোন রিসিভ করেননি। এরপর একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এ দম্পতির হদিস না পেয়ে স্বজনেরা রাতভর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। তারা গাছা থানা, টঙ্গী পূর্ব, পশ্চিম থানা এবং পূবাইল থানায়ও যোগাযোগ করেন। বড় চাচা ও ফুপাকে সঙ্গে নিয়ে মিরাজ পূবাইল থানায় খোঁজ করে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ফিরছিলেন। পথে বাড়ির কাছে গাছা থানাধীন বড়বাড়ির বগারটেক এলাকায় হারবাইদ-বড়বাড়ি সড়কের পাশে জিয়াউর রহমানের প্রাইভেটকারটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন তারা। তারা গাড়ির কাছে এগিয়ে চালকের সিটে বাবা এবং তার পাশের সিটে (সামনে) মায়ের শীতল ও নিথর দেহ দেখতে পান।
নিহতের বড় ভাই রিপন ও শ্যালীকা আহমিদা আক্তার লিমা বলেন, উত্তরা হাসপাতালের চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন, মরদেহের গলায় কালো দাগ রয়েছে। তাদের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তাদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণলঙ্কার, নগদ প্রায় দুই লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন কিছুই নেয়নি হত্যাকারীরা। ঘটনাটি যদি পরিকল্পিত না-ই হতো তাহলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইল ও গাড়ি নিয়ে যেতো। অথচ তাদের কিছুই তারা নেয়নি। শুধু দুইজনের জীবন নিয়ে গেছে।
জিএমপির গাছা জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার মাকসুদুর রহমান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে কয়েকটি সিটিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে আরো সিসিটিভি আশপাশে আছে কিনা সেগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনার কারণ উদঘাটনে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা পুলিশ কর্মকর্তা নাদিউজ্জামান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটি হত্যাকাণ্ড। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হবে। প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত বলা যাবে।’
তিনি জানান, তাঁদের ব্যবহার করা গাড়িটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে তদন্তকাজ চলছে। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মরদেহ উদ্ধার করা প্রাইভেটকারটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন সিআইডির সদস্যরা। তারা প্রাইভেটকার থেকে খাবারের একটি বাটি, কিছু খাবার, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি উদ্ধার করেছেন। পরে এসব জিনিস থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিভি/এমএম/এইচএস
মন্তব্য করুন: