দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হওয়া দেলোয়ার ফিরে আসার প্রতিবাদে উত্তাল গবি

সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয় (গবি) ক্যাম্পাস ফের উত্তাল হয়ে উঠেছে বিতর্কিত সাবেক রেজিস্ট্রার মো. দেলোয়ার হোসেনের পুনর্বহাল ঘিরে। রবিবার (১৯ অক্টোবর) সকালে পাঁচ বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালতের রায়ে তার চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হলে, তিনি পুনর্বহালের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন।
দেলোয়ার হোসেন উপস্থিত হন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস.এইচ. কৃষ্ণসহ সাবেক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় সমর্থকদের সঙ্গে। একাংশ শিক্ষার্থী তাকে ফুলের মালা পরিয়ে স্বাগত জানান। পরে তিনি উপাচার্যের কক্ষে আদালতের রায় ও পুনর্বহালের আবেদনপত্র জমা দেন।
এর আগে গত ৮ অক্টোবর ঢাকার সিনিয়র সহকারী জজ (সাভার) আদালতের বিচারক মো. হাবিবুর রহমান রায়ে উল্লেখ করেন, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখের অব্যাহতি আদেশটি “অবৈধ”।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, "যখন আমাকে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়, সাথে সাথেই আমি হাইকোর্টে রিট মামলা করি। হাইকোর্ট আমাকে সাভার আঞ্চলিক আদালতে পাঠায়। সেখানে চার বছর মামলা চলতে থাকে। এক বছরের জন্য বিবাদী পক্ষ হাজিরা দেয়নি। এরপর এক পাক্ষিক রায় হয়। পরে আরও একবার অর্ডার হয়, আমি তাতেও উপস্থিত থাকিনি। আদালতের নির্দেশমতো সাক্ষীর তথ্য সরবরাহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু যথাযথ সাক্ষী উপস্থিত হয়নি।"
তবে তার পুনর্বহালের খবরে ছাত্র সংসদের সদস্যসহ শিক্ষার্থীদের আরেকাংশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তীব্র। তারা দাবি করেন, দেলোয়ার হোসেন আদালতে "ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য" উপস্থাপন করে রায় আদায় করেছেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, "দেলোয়ার হোসেন দুর্নীতিগ্রস্ত এবং চরিত্রহীন। যে ব্যক্তি নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে অশালীন ফোনালাপে জড়িত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে, তার উপস্থিতি আমরা মেনে নিতে পারি না। তার উপস্থিতি হলে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে।"
এসময় উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। ‘লম্পটের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’, ‘লম্পটের চামড়া, তুলে নিবো আমরা’—এ ধরনের স্লোগান ক্যাম্পাস প্রশাসনিক ভবন উত্তপ্ত করে তোলে। এক পর্যায়ে বাকবিতণ্ডা শুরু হয় দেলোয়ার হোসেনের সমর্থক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ায় দেলোয়ার হোসেন ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।
দেলোয়ার হোসেনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কৃষ্ণ বলেন, "রেজিস্ট্রার দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘ পাঁচ বছর মামলা পরিচালনার পর ০৮/১০/২০২৫ তারিখে আদালত থেকে রায় পেয়েছেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে ১২/০৯/২০২০ তারিখে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, যা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত একইসঙ্গে তার বকেয়া বেতন ও ভাতার পরিশোধের নির্দেশও দিয়েছেন।"
তিনি আরও জানান, "আজ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে তিনি উপাচার্য বরাবর পুনর্বহালের জন্য আবেদন করেছেন। উপাচার্য প্রথমে আবেদন গ্রহণ করলেও ছাত্র সংসদ ও শিক্ষার্থীদের চাপের কারণে তা স্থগিত করেছেন। প্রয়োজনে আমরা পুনরায় আদালতের দ্বারস্থ হব।"
গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মারুফ হোসেন বলেন, "আজ একজন চরিত্রহীন, নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হুমকি দিয়েছে। আমরা এমন কাউকে ক্যাম্পাসে মেনে নিতে পারি না। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি জানাচ্ছে, এ ধরনের ব্যক্তি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতে না পারে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবুল হোসেন বলেন,
"আমরা কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চাই না। আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী তার পুনর্বহাল সম্ভব, তবে ট্রাস্টি বোর্ড ও আইন উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণের পরই তা বাস্তবায়ন হবে। শিক্ষার্থীদের চাপের কারণে আপাতত নথি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।"
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, "বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে আইনগতভাবে আপিল ও স্থগিতাদেশ কার্যকর করব। সাবেক রেজিস্ট্রার দেলোয়ার হোসেনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার মূল কারণ ছিল প্রমাণিত দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অনিয়ম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সম্পত্তি নিয়ে দুর্নীতি করেছেন এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করেছেন, যা আমাদের একাডেমিক ও পেশাদার মানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।"
অতীতের ছায়া: ২০১৭ থেকে ২০২১—বিতর্কের কেন্দ্র দেলোয়ার হোসেন
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন মো. দেলোয়ার হোসেন। কিন্তু তার প্রশাসনিক জীবনে অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই।
২০১৭ সালে এক নারী শিক্ষার্থী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-তে লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তিনি কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি বলে ইউজিসি জানিয়েছিল।
এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরও বড় বিতর্কে জড়ান তিনি। এক নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের জরুরি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তাকে রেজিস্ট্রার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে জমি ক্রয়ে অনিয়ম, একই জমি দু’বার রেজিস্ট্রি করা ও প্রায় ৭৩ লাখ টাকার আত্মসাতের অভিযোগে রিপোর্ট দেয়। এর ভিত্তিতেই তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: