ছড়িয়ে পড়ছে চিকুনগুনিয়া, সতর্ক চীনসহ বিভিন্ন দেশ

ছবি: সংগৃহীত
চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসঘটিত অসুখ, যা প্রধানত এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই একই ধরনের মশা ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার এবং জিকা ভাইরাসও সংক্রমণ করতে পারে। ‘চিকুনগুনিয়া’ নামটি এসেছে আফ্রিকার কিমাকোন্ডে ভাষা থেকে, যার মানে হলো বেঁকে যাওয়া। এই নামটি দেওয়ার কারণ হলো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শরীরের প্রচণ্ড ব্যথার কারণে অনেক সময়ে বেঁকে যান বা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে সংক্রমিত হলে শরীরে কিছু সাধারণ উপসর্গ দেখা যায়, যেমন হঠাৎ জ্বর, ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি এবং জয়েন্টে তীব্র ব্যথা। যদিও বেশিরভাগ মানুষ এক সপ্তাহের মধ্যেই সেরে ওঠে, অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে জয়েন্টের ব্যথায় ভুগে থাকেন। কখনও কখনও এটি কয়েক মাস বা বছরও স্থায়ী হতে পারে। এই রোগটি সাধারণত প্রাণঘাতী নয়, তবে নবজাতক, বয়স্ক ব্যক্তি এবং যারা আগে থেকেই হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটি গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ হতে পারে।
আল-জাজিরার তথ্য মতে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২,৪০,০০০-এ পৌঁছেছে এবং মৃত্যু হয়েছে ৯০ জনের। এ পর্যন্ত ১৬টি দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, লা রিইউনিয়ন, মাদাগাস্কার, চীন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। লা রিইউনিয়নে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা গেছে। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪,০০০ ছাড়িয়ে গেছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১২ জন। চীনে জুন মাসের শেষের দিক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭,০০০ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, যারা বেশিরভাগই গুয়াংডং প্রদেশের ফোশান শহরের বাসিন্দা।
চীন সরকার চিকুনগুনিয়া ভাইরাস প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দেশটিতে ড্রোনের মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল শনাক্ত করা হচ্ছে, যাতে তাদের দ্রুত ধ্বংস করা যায়। পাশাপাশি বিশেষ ধরনের হাতি মশা ছাড়া হয়েছে, যেগুলোর লার্ভা ভাইরাস বহনকারী ছোট মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। সরকারি নির্দেশনায় বাসিন্দাদের বলা হয়েছে যেন তারা আশপাশে কোথাও পানি জমতে না দেয়। ফুলদানি, কফির মেশিনের রিজার্ভার বা ফাঁকা বোতলে যেন পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশনা না মানলে ১০,০০০ ইউয়ান (প্রায় ১,৪০০ ডলার) পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে এবং গুরুতর ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া এলাকাগুলোতে আক্রান্তদের আলাদা করে কোয়ারেন্টাইনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, যাতে রোগ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
অন্যান্য দেশ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। লা রিইউনিয়নে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে, মশা দমন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে এবং টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। স্পেনে সীমান্ত এলাকাগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রিপোর্ট করার সুযোগ রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকারীদের জন্য সতর্কতা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে।
রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো পুরো হাত ঢাকা জামা ও লম্বা প্যান্ট পরা, মশা তাড়ানোর জন্য উপযুক্ত প্রতিরোধক ব্যবহার করা, ঘরের আশপাশে কোথাও পানি জমে থাকতে না দেওয়া এবং মশারির ভেতরে কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকা। এই রোগের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। সাধারণত বিশ্রাম নেওয়া, প্রচুর পানি পান করা এবং ব্যথা উপশমের জন্য উপযুক্ত ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
চিকুনগুনিয়া সাধারণত প্রাণঘাতী না হলেও এর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ও দীর্ঘস্থায়ী জয়েন্টের ব্যথা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। চীনসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যেই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সামাজিক সহযোগিতাই সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে।
বিভি/আইজে
মন্তব্য করুন: