৬০ বছরে সিঙ্গাপুর: যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতার মাঝে সিঙ্গাপুরের কূটনৈতিক দোলাচল

ছবি: সংগৃহীত
আতশবাজির ঝলকানিতে উদ্ভাসিত হবে সিঙ্গাপুরের আকাশরেখা। এবার স্বাধীনতার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশটি উদ্যাপন করছে তাদের অর্জন ও অগ্রযাত্রা। যদিও ভবিষ্যতে মোকাবেলা করার মতো নানা সমস্যাও রয়ে গেছে দেশটিতে। ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা লাভের পর সিঙ্গাপুর ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তুলেছে এক আধুনিক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে। আজকের সুউচ্চ ভবনগুলো সেই উন্নয়নেরই প্রতীক।
মাত্র ৬০ লাখ মানুষের ছোট এই দ্বীপরাষ্ট্রটি বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাত। যদিও দেশটি নানা সফলতা উদ্যাপন করছে, তবে ভবিষ্যতের পথে বেশ কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে সিঙ্গাপুরের সামনে আসন্ন বড় কয়েকটি চ্যালেঞ্জের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুতর হুমকির মুখে রয়েছে। দেশটি সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী হওয়ায় এর ওপর জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভবিষ্যতে ঘন ঘন ভারী বর্ষণ, বন্যা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিঙ্গাপুরে বড় ধরণের সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সমুদ্রের পানি এক মিটারের বেশি বাড়ে তাহলে রাজধানীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ডুবে যেতে পারে। এ বিপদ মোকাবেলায় পূর্ব উপকূলে ৩টি ম্যান মেইড দ্বীপ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেগুলো মূল ভূখণ্ডের তুলনায় বেশি উঁচু হবে, যেন ভবিষ্যতের জলাবদ্ধতা বা বন্যা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো ভবিষ্যতে দেশের গড় তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এই ধরনের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাইরে কাজ করা শ্রমিকরা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বেন, যা জনস্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সিঙ্গাপুরে লোকজন ক্রমেই বৃদ্ধ হচ্ছে এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ৪ জন নাগরিকের একজনের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি হবে। যদিও এই পরিস্থিতি উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও দীর্ঘায়ুর কারণে সম্ভব হয়েছে। তবে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ার ফলে স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সহায়তা এবং জনবল চাহিদাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এর প্রভাব শুধু স্বাস্থ্য খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পরিবারগুলোও মানসিক ও আর্থিক চাপে পড়বে।
সিঙ্গাপুরে জন্মহার ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে দেশটির মোট উর্বরতার হার জাপানের তুলনায়ও নিচে নেমে এসেছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে পরিবার গঠনের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে, যার ফলে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের জন্য পর্যাপ্ত জনবল সংকট দেখা দিতে পারে। এই সমস্যা মোকাবেলায় নীতিনির্ধারকরা সন্তান পালনের প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন।
বিশ্বব্যাপী অস্থির পরিবেশে সিঙ্গাপুরের জন্য নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা দিন দিন আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সিঙ্গাপুরের পক্ষে দুপক্ষের সঙ্গে সমান সম্পর্ক রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যদিও সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতার নীতিতে অটল থাকে। তবে বাস্তবিকভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে সিঙ্গাপুর কখনো কখনো চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে।
সিঙ্গাপুরে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বর্তমানে স্থিতিশীল থাকলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ২০২৫ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন পিপলস অ্যাকশন পার্টি মোট ভোটের ৬৫ শতাংশ পেয়ে অধিকাংশ আসনে বিজয়ী হয়েছে। তবে তরুণদের মধ্যে একধরনের নতুন রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠছে। তারা চাইছে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি এবং অধিক স্বাধীনতা। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
গত ৬০ বছরে অসাধারণ উন্নতি করেছে সিঙ্গাপুর। তবে পরবর্তী ৬০ বছরকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে দেশটিকে। ফলে সিঙ্গাপুরকে তার প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সমাজের ঐক্যবদ্ধতা কাজে লাগাতে হবে।
বিভি/আইজে
মন্তব্য করুন: