• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪

নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা

চোখের সামনে ২৯ সহযাত্রীকে মরতে দেখেও বোট ছাড়েননি সামিউল

হারুন আনসারী, ফরিদপুর প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ১৬ মার্চ ২০২২

আপডেট: ১৬:১৩, ১৬ মার্চ ২০২২

ফন্ট সাইজ
চোখের সামনে ২৯ সহযাত্রীকে মরতে দেখেও বোট ছাড়েননি সামিউল

সামিউল শেখ

সাগরের বুকে নৌকায় চেয়ে স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ তিন বন্ধুর একজন সামিউল শেখ (২১) ফিরে এসেছেন দেশে। সাতদিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে তিনি এখন বাড়িতে। তার অপর দুই বন্ধু মইন ও নাজমুল সাগরে ডুবে মরে গেছে। তাদের সাথে আরো ২৯ জনের সলিলসমাধী হয়েছে ভূমধ্যসাগরে। সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরছে তাকে। 


এবছরের ২২ জানুয়ারীর দিকে ছোট নৌযানে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতিালি যাওয়ার পথে ঠান্ডায় জমে মারা যান সাতজন। এ ঘটনার পর মাত্র পাচঁদিন পরে ২৭ জানুয়ারী তাদের ৩৫ জনকে একইভাবে ইতালির উদ্দেশে এক ইঞ্জিনের একটি নৌকায় পাঠানো হয়। যাদের মধ্যে সামিউলসহ মাত্র সাতজন বেঁচে ফিরতে পেরেছে। সামিউল শেখ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার দক্ষিণ কাইচাইল গ্রামের ইউনুস শেখের ছেলে। তাঁর দুই বন্ধু বাবুর কাইচাইল গ্রামের ফারুক মাতুব্বরের ছেলে মইন মাতুব্বর ফয়সাল (১৯) ও মাজেদ মিয়ার ছেলে নাজমুল মিয়া (২২) সহ তাদের তিনজনের পরিবার ৩০ লাখ টাকায় তাদের ইউরোপে পাঠাতে দালালের শরণাপন্ন হয়। এরপর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় মৃত্যুপূরীতে। 

আরও পড়ুন:


মানবপাচারকারী চক্রের দালাল রাসেল ও শওকত ঢাকা হতে গত বছরের ১৭ নভেম্বর বিমানে তাদের তিন বন্ধুকে দুবাই নিয়ে যাওয়ার পর ১ ডিসেম্বর নিয়ে যায় লিবিয়া। সেখানে নিয়ে তাদের ঘরবন্দি করে রাখা হয় প্রায় দুই মাস। সামিউল বলেন, যাদের মাধ্যমে আমরা গিয়েছিলাম তারা আমার আত্মীয় হতো। তাই ভাবিনি যে ওরা আমাদের জীবন নিয়ে খেলবে। কিন্তু লিবিয়ায় পৌছার পরে আমরা ওদের কাছে জিম্মি হয়ে যাই। বাইরে বের হতে চাইলে গুলি করার ভয় দেখাতো। বাইরে যুদ্ধ হচ্ছে বলতো আবার মালিকের সাতটি পিস্তল আছে, সেগুলো দিয়ে গুলি করে দিবে বলতো। সামিউল বলেন, ছোট ওই ঘরে ২০ জনের মতো ছিলাম। সারাদিনে খুবজু নামে একটি লম্বা বনরুটি দিতো। ১শ’ গ্রামের মতো ওজন হবে এর। সেটি সকালে অর্ধেক ও দুপুরে অর্ধেক খেতাম। রাতে কখনো কখনো সামান্য ভাত দিতো। এরপর তাদেরকে নরসিংদীর মনির শীল নামে মানবপাচার চক্রের আরেক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। মনির তাদের হাতবদল করে অলিদ নামে আরেক দালালের কাছে। 


প্রায় দুই মাস বন্দিদশায় থাকার পর ২৭ জানুয়ারি তাদেরকে লিবিয়ার জোয়ারা ঘাট হতে ইতালির উদ্দেশ একটি স্পিডবোডে তোলা হয়। লাইফ জ্যাকেট এবং শুকনা খাবার দিবে। কিন্তু যেই স্পিডবোটে তুলেছিলো সেখানে ২০ জনের মতো লোক বসতে পারে। অথচ দুজন চালকসহ তারা ৩৭ জন ওই বোটে তোলা হয়। গুলিকরার ভয় দেখানোয় বাধ্য হয়ে সবাই বোটে ওঠেন। প্রায় আট ঘণ্টা চলার পর হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে তাদের স্পিডবোটটি উল্টে গেলে ২৯ জন সাগরের পানিতে ভেসে যান। সামিউল জানান, তাদেরকে একটি মালবাহী জাহাজে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পিস্তল ঠেকিয়ে সাগর পাড়ে যেয়ে তাদের স্প্রিড বোটে উঠতে বলে। ভাবলাম এতে না উঠলেও মরবো। তাই মৃত্যুর কথা জেনেও রওনা দেই।
সামিউল বলেন, স্পিডবোটের অন্য পাশ ধরে আমরা আটজন ভাসতে থাকি। এভাবে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর আমার বন্ধু নাজমুল ঢেউয়ের তোড়ে ছিটকে পড়ে। এরপর আমরা সাতজন সাড়ে ১১ ঘণ্টা ভাসতে থাকি। তখন একজনের একটি গেঞ্জি ছাড়া আমাদের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। এসময় দূরে একটি জাহাজ দেখে আমাদের একজন (নরসিংদীর ফারুক) একটি লাল গেঞ্জি উঁচু করে দেখাতে থাকে। জাহাজটি ছিল লিবিয়ার কোস্টগার্ডের। তাঁরা আমাদের দেখতে পেয়ে জাহাজে তুলে বুট দিয়ে লাথি মারতে শুরু করে। ওই জাহাজেই রাশেদুল নামে একজন মারা যান। তাঁকে লিবিয়ায় এনে দাফন হয়। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার পথে মিসরের ২ চালকসহ মোট ৩৭ জনের মধ্যে বেঁচে ফেরেন ৬ জন। সামিউল আরও বলেন,  সাড়ে ১১ ঘণ্টা আমরা কিছুই না খেয়ে সমুদ্রে ভাসছিলাম।  জাহাজে ওঠার পর আমাদের শারীরিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে প্রাণের দুই বন্ধুকে হারায় ফেলেছি। আর কি বলবো?’ কান্নায় কন্ঠ থেমে আসে তার।

তাদেরকে এভাবে মুত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া ভয়ংকর মানবপাচারকারী দালাল শওকত চৌধুরী (২৮) ও রাসেল মিয়া (২৪) এখনো গ্রেফতার হয়নি। সম্পর্কে তারা মামাতো-ফুফাতো ভাই। 


এদিকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের সাংবাদিকগণ সামিউল ও তার বন্ধুদের নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার খবর প্রকাশ করলে দুতাবাস এব্যাপারে তৎপরতা শুরু করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) তাদের খোঁজ বের করে। এরপর ২ মার্চ নগরকান্দার সামিউল শেখ নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের ইউসুফ মৃধা, একই জেলার নালিখা গ্রামের ইয়াসিন, বেলাব থানার ফারুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাকির ও মাদারীপুরের ইউনুসকে দেশে ফিরিয়ে আনে। সাত দিন কোয়ারেন্টিন শেষে ১০ মার্চ তারা বাড়িতে ফিরে।
অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ির সঙ্গে জড়িত দালাল চক্রের মধ্যে দেশে আছেন দুজন। আর লিবিয়ায় দুজন। দেশের দুই দালাল হলেন নগরকান্দার কাইচাইল ইউনিয়নের ছোট নাওডুবি গ্রামের হান্নান মাতুব্বরের ছেলে শাহিন মাতুব্বর (৪১) ও মৃত শামসুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে ইলিয়াস মাতুব্বর (৩৯)। আর লিবিয়ার দুজন হলেন ছোট নাওডুবি গ্রামের মৃত শামছুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে শওকত মাতুব্বর (২৫) ও চানু মাতুব্বরের ছেলে রাসেল মাতুব্বর (৩৫)। চার বছর ধরে তাঁরা লিবিয়ায় থাকেন।

সামিউলের বাবা ইউনুস শেখ জানান, সামিউল নগরকান্দা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। বিদেশে যাওয়ায় তাঁর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, তাদের পাশের গ্রামের শওকত মাতুব্বর ও রাসেল মাতুব্বর নামে দুজন তাদের দুর সম্পর্কের আত্মীয় হন। তারা লিবিয়া থাকেন। এর আগে কয়েকজনকে এভাবে বিদেশে পাঠিয়েছে। তাদের কথামতোই ৩০ লাখ টাকায় সামিউল, নাজমুল ও ফয়সালকে বিদেশে পাঠাই। এরমধ্যে ২০ লাখ টাকা দিয়েছি। ইতালি যেতে পারলে বাকি টাকা পরিশোধ করার কথা ছিলো। 


এদিকে সামিউলের ভাষ্য অনুযায়ী ভূমধ্যসাগরে ভেসে যাওয়া নাজমুলের বড় ভাই সম্রাট মিয়া বলেন, ‘আমার মা নাজমুলের খবর জেনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাবাও জ্ঞানহারা। তিনি মানবপাচারকারী চক্রের বিচার দাবি করে বলেন, ওদের সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে। নইলে আরো অনেক পরিবার নিঃস্ব হবে। এভাবে মরবে।’


সামিউলের মা সালমা বেমগ বলেন, আমার ছেলে ফিরে এসেছে। কিন্তু ওর দুই বন্ধু এখনো ফিরে আসেনি। যারা ওদের এভাবে মারছে তাদের আমি ফাঁসি চাই। ফয়সালের বাবা ফারুক মাতুব্বর বলেন, আমার ছেলে দালালদের হাতে বিদেশে যেতে গিয়ে মারাই গেছে। আমার স্ত্রী একথা জেনে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। আমিও অসুস্থ্য। শুনলাম এরই মধ্যে একজন আসামী জামিনে বেরিয়ে এসেছে। আমি ওদের ফাঁসি চাই।


এদিকে এখানো নিখোঁজদের একজন ফয়সাল মাতুব্বর মইনের পিতা ফারুক মাতুব্বর বাদী হয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নগরকান্দা থানায় এ ঘটনায় ১০ জনকে আসামি করে মানব পাচার আইনে একটি মামলা দায়েরের পর পুলিশ হান্নান মাতুব্বর ও তার ছেলে তুহিন মাতুব্বর নামে দুজন আসামীকে গ্রেফতার করে। সন্দেহভাজন হিসেবে কাজল মাতুব্বর নামে আরো একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগরকান্দা থানার এসআই পীযূষ কান্তি দে বলেন, এ ঘটনায় বেঁচে ফেরা সামিউল সোমবার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।


এব্যাপারে নগরকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, মামলাটি তদন্ত চলছে। আসামীদের মধ্যে প্রধান দুজন শওকত ও রাসেল বর্তমানে বিদেশে রয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে হলে ইন্টারপোল অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়ংতা নিতে হবে। এখন তাদের ব্যাপারে তথ্য যাচাইবাছাই চলছে এভাবে আরো কতজনের সাথে তারা প্রতারণা করেছে কিংবা বিদেশে নিয়েছে। তিনি বলেন, তথ্য যাচাই শেষে তারা প্রতিবেদনসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাবেন।


অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নগরকান্দা সার্কেল) মো. সুমিনূর রহমান বলেন, মামলা হয়েছে পুলিশ তদন্ত করে চার্জশীট দিবে। এরপর তাদের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলে দুতাবাসের মাধ্যমে বিদেশে থাকা আসামীদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, নাজমুল ও মইন মাতুব্বরের ব্যাপারে এখনো অফিসিয়ালি কোন তথ্য জানা যায়নি তাই তাদের ভাগ্যে আসলেই কি হয়েছে তা বলতে পারছিনা।

মন্তব্য করুন: