এসব কী হচ্ছে বইমেলায়?
দর্শনার্থীতে উপচে পড়া বইমেলার ফাইল ছবি
বইমেলা নামে প্রচলিত মহান একুশে গ্রন্থমেলা এবার শুরু থেকেই আলোচনায়। অতিমারী করোনাকাল এবং তার পরের দু’বছর যে ভাটার টান ছিল তা কাটিয়ে এবার মেলায় অনেকটা জোয়ার বইছে। মেলার শুরুর দিনই ছিল উপচেপড়া ভীড়। এরপর দিন যত গড়িয়েছে আর গড়াচ্ছে ততই মেলায় মানুষের সমাগম বাড়ছে। প্রতিটি বিকেল সব শ্রেণি পেশা আর বয়সের মানুষের পদচারণা আর আড্ডায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার দুই অঙ্গণ। বই আর আড্ডার টানে ছুটে আসেন হাজারো মানুষ।
বই মেলায় বইকে ঘিরে মানুষের সমাগম হবে সেটাই স্বাভাবিক। মেলায় যেমন আসেন বইপ্রেমী পাঠক তেমনি আসেন লেখক-কবি। আরও নানা কারণে অনেকেই আসেন মেলায়। বইয়ের কারণে এ মেলা আর সে বইয়ের জন্য এ মেলা আলোচিত হলেও এবারের বইমেলা কিছুটা হলেও নেতিবাচক আলোচনার শিকার হয়েছে, মূলত: কিছু ব্যক্তির লেখালেখি আর তাদের আচরণগত কারণেই এ আলোচনা-সমালোচনা।
আরও পড়ুন: গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বেশিই জমজমাট বইমেলা
করোনাকালে করোনা পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে কারাভোগ করে মুক্তি পেয়েই বই লিখে ফেলেছেন ডা. সাবরিনা। বইটির প্রচারণা করতে গিয়ে তিনি নিয়মিত যেসব কাণ্ডকীর্তি ঘটাচ্ছেন তা মানুষের মধ্যে বিরক্তির সৃষ্টি করছে, হাস্যরসের তৈরি করছে। বইমেলার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এমন কথাও বলছেন অনেকে। তিনি তার বই কেনার জন্য কান্নাজড়িত কন্ঠে যে আকুতি জানিয়েছেন তা তার বই কেনায় মানুষকে কতটা আগ্রহী করেছে কিংবা আকৃষ্ট করেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে বইমেলায় প্রকাশনা স্টলে তিনি বসছেন এবং নিজের বইটি বিক্রির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। কিছু পাঠকও তার সান্নিধ্য পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন বইমেলায় তার স্টলে।
এবারের বইমেলায় সবচে’ বিতর্ক হয়েছে বহুল আলোচিত মোশতাক ও তিশা দম্পতিকে ঘিরে। সামঞ্জস্যবিহীন বয়সী এই দম্পত্তি মেলায় এসেছিলেন। তাদেরকে বইমেলা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে একদল তরুণ। বাংলা একাডেমির আনসাররা তাদের দু’জনকে বইমেলা থেকে নিরাপত্তা দিয়ে বের করে দেয়। এরপরও তারা থেমে নেই, তারা তাদের বিয়েসহ নানা বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছেন।
বইমেলার আরেক আলোচিত চরিত্র টিপু সুলতান। তিনি বই লিখেছেন তা মেলায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছেন। শুধু বই বিক্রি করছেন না, তিনি নানাভাবে মেলায় আসা মানুষের ইংরেজি জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়ে বিপাকে ফেলছেন অনেককে, তৈরি করছেন বিব্রতকর পরিস্থিতি। টিপু সুলতান ঘুরে ঘুরে বইবিক্রি করারই মানুষ। রাজধানীর বাস বা ট্রেনে চলাচলকারী ব্যক্তিদের অনেকেই তাকে চেনেন। তিনি দীর্ঘদিন বাসে-ট্রেনে বই বিক্রি করছেন। যানবাহনে বই বিক্রি নতুন কিছু না, হকারদের একটি অংশ গাড়িতে, ট্রেনে লঞ্চে বই বিক্রি করেন, কিন্তু লেখক নিজে বই নিয়ে যানবাহনে উঠে সেই বইয়ের গুণকীর্তন করছেন আর তা বিক্রি করছেন এমনটা মনে হয় না টিপু সুলতান ছাড়া আর কেউ করেছে।
গত ক’ বছর ধরে বইমেলায় নিয়মিতই আসেন হিরো আলম। তিনি বই লিখেছেন। অন্যবার তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও তিনি কখনও বিরূপ পরিস্থিতিতে বা তোপের মুখে পড়েননি, এবার তাকেও বইমেলা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ক্ষুব্ধ তরুণদের অনেকেই বলেছেন, হিরো আলম এমন কি করেছেন যে জন্য তাকে বই লিখতে হবে, আর তা মানুষকে পড়তে হবে? তার জীবন থেকে মানুষের শেখার কী আছে?
আরও পড়ুন: ফাল্গুন আর ভালোবাসায় বইমেলায় অনন্য রূপ
বইমেলা হচ্ছে বাঙালী সংস্কৃতির একটি সুবিশাল আয়োজন। দেশের প্রকাশনা শিল্প অনেকটা বইমেলা নির্ভর। শখের লেখক তো বটেই অনেক নিয়মিত লেখকও বই প্রকাশের মোক্ষম সময় মনে করেন ফেব্রুয়ারি মাস অর্থাৎ বইমেলার এ সময়টাকে। বই বিক্রি করতে লেখকরা নানাভাবে চেষ্টা চালান। পাঠক যাতে বই নেন সে জন্য লেখকের চেষ্টা চালানো দোষের কিছু নয়, তবে চেষ্টার পাশাপাশি কেউ যদি বই কেনার জন্য পাঠকের (চেনা কিংবা অচেনা যাইহোক) কাছে তদ্বির করেন তা অশোভন। আবার একজন লেখকের ঘুরে কিংবা মানুষের হাতে-পায়ে ধরে, কান্নাকাটি করে বই বিক্রির বিষয়টি শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, এটা একজন লেখকের মর্যাদার সাথেও যায় না।
বইমেলা শুধু বইয়ের মেলা নয়, এটা বাঙালীর মিলন মেলাও বটে। তাই মেলায় যারা আসেন সবাই বই কিনতে আসেন না। বইমেলা দেখতেও আসেন, অবসর সময় কাটাতে আসেন। বাণিজ্যমেলায় টিকেট কেটে ঢোকার কথা টেনে কেউ বলতে পারেন, ‘ফাও পাইলে বাঙালী আলকাতরাও খায়’। এটা হতে পারে, তাই বলে ফাও বলেই বাঙালী বই মেলায় যায় এমনটা নাও হতে পারে। তারপরও যদি কেউ তা মনে করেন, করতে পারেন।
তবে মানুষের বইমেলায় যাওয়াটাকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। যে আপু কিংবা ভাইয়া ‘বুক’ বলতে বোঝেন ‘ফেসবুক তারা, এমনকি যে মামা-চাচী বইমেলায় ‘অন্যকিছু’ পাওয়া যায় না? এ প্রশ্ন করেন কিংবা যে চাচা, খালু বইমেলা জিনিষটা কেমন একটু ‘দেইখ্যা’ আসি, ভেবেও বইমেলায় যান, তাদেরও বই মেলায় স্বাগত জানানো উচিত।
বইমেলা দিন দিন মানুষের মেলা হয়ে উঠছে, বইমেলায় মানুষের ক্রমাগত ভীড় বাড়া কারো কারো জন্য বিরক্তির এবং অনেকের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হলেও বিশ্বাস করি তা মানুষের এই সমাগম, তাদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছে। হয়তো এমন একদিন আসবে এই বাঙালী বইকেনার জন্যই বইমেলায় আসবে, টিকেট কেনা লাগলেও আসবে।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: